-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৫ম পর্ব): মৃত্যুর প্রতীক্ষায়
৩০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সকাল নয়টার দিকে আমরা শামীমদের বাসা থেকে বেরিয়ে আমাদের বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। রকম ওয়াহেদে অবস্থিত ন্যাটোর বোমায় বিধ্বস্ত একটা স্কুল, বিদ্রোহীদের মিসাইলে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ওয়াহদা ব্যাংক এবং মেইন রোডের দুপাশে লুটপাট হওয়া দোকানপাটগুলো দেখতে দেখতে আমরা এগোচ্ছিলাম।
রাস্তাগুলো গাড়ি চলাচলের অযোগ্য। রকেট পড়ে জায়গায় জায়গায় রাস্তা গর্ত হয়ে আছে। হাইডলার রোড থেকে শুরু করে রকম ওয়াহেদ এবং রকম এতনিনের সামনের মেইন রোড এক থেকে দেড় ফিট পানির নিচে তলিয়ে আছে। সম্ভবত গোলার আঘাতে জায়গায় জায়গায় ফেটে যাওয়া পানির পাইপের কারণেই এ অবস্থা।
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৩য় পর্ব): গন্তব্য অজানা
শুক্রবারের পুরো দুপুর এবং বিকেল আমরা না খেয়ে কাটালাম। মাস্তুরার (বাড়িওয়ালা কামালের স্ত্রী) মায়েরা এমনিতেই গরীব, তাছাড়া গত চার মাস ধরে তাদের উপর বসে বসে খাচ্ছিল মাস্তুরার মামাতো ভাই আ’ত হারাগাদের একটা বিশাল পরিবার এবং তাদের প্রতিবেশী বুসেফিদের পরিবার, যারা মিসরাতা যুদ্ধের সময় মিসরাতা থেকে সিরতে পালিয়ে এসেছিল।
সন্ধ্যার সময় খাবার দিল, কিন্তু তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কুসকুসি, কোন মাংস বা তরকারি ছাড়াই। অবশ্য কারেন্ট না থাকার কারণে কারো বাসায় মাংস বা তরকারি আশা করাটাও বোকামি।
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৭ম পর্ব): বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে
উদ্ধার হওয়ার পর আমাদেরকে বেশিক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করতে হলো না। সেই দাড়ি-টুপি এবং চশমাওয়ালা বৃদ্ধ আমাদেরকে এক যোদ্ধার গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে পেছন পেছন আসতে লাগলো। সেই যোদ্ধা গাড়িতে উঠেই প্রথমে আমাদেরকে বলল, গুল গাদ্দাফি ক্যাল্ব। অর্থাৎ, বল গাদ্দাফি কুত্তা।
আমরা সবাই-ই সম্মতিসূচক একটা হাসি দিলাম, কিন্তু প্রথমে কেউই উচ্চারণ করলাম না। গাদ্দাফির এই মুহূর্তের নীতি খারাপ, কিন্তু জন্মের পর থেকে তো তার দেশেই খেয়ে পরে বড় হচ্ছি, এত সহজে তাকে এভাবে গালি দেই কীভাবে?
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (১ম পর্ব): ব্যাট্ল ফর সিরত
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আটমাস ধরে পুরো লিবিয়া জুড়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি ছিল সিরত যুদ্ধ – গাদ্দাফির জন্মস্থান সিরতের জন্য যুদ্ধ। সিরতের মধ্যে যে এলাকাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো এক মাস পাঁচ দিন ব্যাপী যে এলাকাটিতে তুমুল যুদ্ধ চলেছে এবং যে এলাকাটিতে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফি আত্মগোপন করে ছিল, তার নাম রকম এতনিন (এরিয়া নাম্বার টু)। আর দুর্ভাগ্যবশত আমরা ছিলাম সেই রকম এতনিনের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জাফরানের অধিবাসী।
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (২য় পর্ব): বিদ্রোহীদের কবলে
১৬ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আগের দিন রাতের বেলা ছাড়াছাড়া ঘুম হয়েছিল, তবুও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। নাস্তা করে এলাকাটা দেখতে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম পুরো এলাকা ফাঁকা। রাতে রাতেই বেশির ভাগ মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
মেইন রোডে গিয়ে দেখি রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে উপড়ে পড়ে আছে। দুপাশের দোকানগুলোর দরজা, দেয়াল ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। কাঁচের টুকরার জন্য রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছে না। এলাকার প্রায় প্রতিটা দোতলা-তিনতলা বাড়ির দেয়ালে কয়েকটা করে গুলির ছিদ্র। আশেপাশের বাঙ্গালিদের বাসায় গিয়েও একটু খোঁজ-খবর নিলাম। সৌরভরা, মুক্তারা, হিরণ ভাইরা – সবাই-ই ভালো আছে।
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৮ম পর্ব): প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন
শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১
সকাল দশটার দিকে আমরা খামসিন থেকে বের হয়ে সিরতের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সাথে প্রচুর পরিমাণ খাবার-দাবার। যাচ্ছি একটা ট্রাকের পেছনে চড়ে। খামসিনের চেক পয়েন্ট থেকে বিদ্রোহীরা এই ট্রাকওয়ালাকে রিকোয়েস্ট করে আমাদেরকে উঠিয়ে দিয়েছে।
রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দেখলাম যুদ্ধের 犀利士 গাড়ি তেমন নেই, কিন্তু সাধারণ পিকআপে আর ট্রাকে করে মানুষ দামী দামী গাড়ি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনসহ দামী দামী জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন দোকানপাট এবং বড়লোকদের বাড়ি থেকে লুটপাট করা জিনিস এগুলো।
(more…) -
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৪র্থ পর্ব): নরকে প্রত্যাবর্তন
আশরিনে আমাদের দিনগুলো মোটামুটি ভালোই কাটছিল। প্রথম দিন আমাদেরকে বেশ ভালোই আপ্যায়ন করল। দুপুরে একটা খারুফ (ভেড়া) জবাই করে মাকরোনা দিয়ে খেতে দিলো। বিকেলে আবার খুবজা দিয়ে চা।
দিনের বেলাটা আমাদের ভালোই কাটল। বাসা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। বিকেলের দিকে বাচ্চাকাচ্চা সহ আমরা সবাই সমুদ্রে গেলাম। যুদ্ধের কোনো চিহ্নও এই এলাকাতে নেই। ন্যাটোর ফাইটারগুলোও এদিকে আসে না। শুধু অ্যাপাচি হেলিকপ্টারগুলো খুব নিচে দিয়ে ওড়ে, একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়।
-
লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৬ষ্ঠ পর্ব): দ্বিতীয় জীবন
শনিবার, ১৫ই অক্টোবর ২০১১
সারাদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। সন্ধ্যার সময় যখন গোলাগুলির আওয়াজ কমে এলো, তখন আমাদের বাসা থেকে ছয়-সাতশো মিটার দূরে অবস্থিত রমজান আঙ্কেলদের এলাকা থেকে হঠাৎ আল্লাহু আকবার শ্লোগান শোনা যেতে লাগলো। আমাদের বুকের মাঝে রক্ত যেন ছলকে উঠল। তারমানে কি বিদ্রোহীরা আরও এগিয়ে আসছে? যুদ্ধ কি শেষ হয়ে আসছে?