আরব বসন্ত অফিশিয়ালি শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়া থেকে। কিন্তু বাস্তবে তিউনিসিয়ার আন্দোলনটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই চাপা পড়ে যেতে পারত, যদি না সেই আন্দোলন মিশরে গড়াত, যদি না ২৫ জানুয়ারি তাহরির স্কয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে মোবারককেও বেন আলির মতো পদত্যাগে বাধ্য করত।
তিউনিসিয়ার আন্দলনটা এতই বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা ছিল, পশ্চিমা বিশ্বও সেটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। যেই ফ্রান্স মাত্র দুই মাস পরেই গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে ছেড়েছিল, সেই ফ্রান্সই তিউনিসিয়াতে উল্টা আন্দোলন দমন করার জন্য বেন আলির পক্ষে সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় কোনো দেশই তিউনিসিয়ার আন্দোলনকারীদের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেনি। তিউনিসিয়ার জনগণ নিজেরাই আন্দোলনকে সফল করে তুলেছিল।
তিউনিসিয়ার দেখাদেখি শুরু হওয়া মিশরের আন্দোলন নিয়েও শুরুর দিকে পশ্চিমারা দ্বিধাবিভক্ত ছিল। খোদ বারাক ওবামার প্রশাসন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, কী করা উচিত। যেই হিলারি ক্লিন্টনকে অনেকেই আরব বসন্তের জন্য দায়ী করে থাকে, সেই হিলারি পর্যন্ত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। তার বক্তব্য ছিল, হোসনি মোবারক আমেরিকা এবং ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র। তাকে ত্যাগ করা আমেরিকার উচিত হবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলন যখন বেগবান হয়ে ওঠে, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা ওবামা নিজেই গ্রহণ করে – হিলারিসহ মার্কিন এস্ট্যাবলিশমেন্টের অনেকের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েই ওবামা সিআইএর উপপ্রধানের মাধ্যমে মিশরীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে বার্তা পাঠায়, মোবারককে সরে যেতে হবে। এর পরপরই মোবারক পদত্যাগের ঘোষণা দেয়। বা বলা যায় দিতে বাধ্য হয়।
মোবারকের পতনের পরেই মূলত আরব বসন্তের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে যায়। এর পরপরই যখন লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে আন্দোলন শুরু হয়, তখন সবাই মনে করতে শুরু করে, যেহেতু অল্পদিনেই পরপর দুইজন শক্তিশালী স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে, তাই বাকিরাও টিকতে পারবে না। কাজেই তাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করাটাই হবে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে। ফলে একেবারে শুরু থেকেই বিদেশীরা লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য করতে শুরু করে এবং এইসব দেশের সরকারের পতন নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
তিউনিসিয়ার পরে যদি মিশরের পতন না ঘটত, মোবারক যদি কোনোভাবে টিকে যেত, তাহলে আরব বসন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারত। শুধু এটাই না, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারত তিউনিসিয়ায় বু’আজিজি যদি ডিসেম্বরে গায়ে আগুন না দিয়ে জুলাই বা আগস্ট মাসে দিত। সেক্ষেত্রেও হয়তো বেন আলির পতন ঘটত, হয়তো মিশরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ত, কিন্তু জানুয়ারিতে যে বিপুল পরিমাণ মানুষ তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয়েছিল, সেটা খুব সম্ভবত হতো না। ফলে মোবারকেরও পতন ঘটত না। এবং বাকি দেশগুলোর উপরেও তার প্রভাব পড়ত না।
কেন? কারণ তারিখগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ই ডিসেম্বরে বুআজিজি গায়ে আগুন দেওয়ার পর থেকেই তিউনিসিয়াতে আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে। কিন্তু ৪ জানুয়ারি বুআজিজির মৃত্যুর পরেই মূলত আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এবং এর ১১ দিন পর ১৫ই জানুয়ারি বেন আলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তিউনিসিয়ার আন্দোলনের সাফল্য দেখে মিশরীয়রা উদ্বুদ্ধ হয় এবং তারা এর মাত্র ১০ দিন পর, ২৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে আন্দোলনের ডাক দেয়। এই ২৫ জানুয়ারি তারিখটা যদি ঠিক ঐ সময়ে না আসত, তাহলে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন হতে পারত।
২৫ জানুয়ারি তারিখটা মিশরের জাতীয় দিবস। দিনটা মিশরে পুলিশ দিবস নামে পরিচিত। কারণ ১৯৫২ সালের এই দিনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যখন মিশরীয় পুলিশকে অস্ত্র সমর্পণ করে ইসমাইলিয়া থানার নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন তারা তাতে রাজি না হয়ে বিদ্রোহ করলে ব্রিটিশরা গুলি বর্ষণ করে, এবং এর ফলে ৫০ জন মিশরীয় পুলিশ শহিদ হয়। সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই পরবর্তীতে ২৫ জানুয়ারি দিনটাকে পুলিশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পুলিশ দিবসে মানুষের স্মরণ করার কথা পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস। কিন্তু সেটা ঘটে যদি পরবর্তীকালে নিজের দেশের নাগরিকদের সাথে পুলিশের আচরণ সুন্দর হয়। কিন্তু যদি বিপরীতটা ঘটে? যদি স্বৈরশাসনের অধীনে পুলিশ নিজেই রক্ষক না হয়ে ভক্ষক হয়ে ওঠে? যদি রাষ্ট্রই হয়ে ওঠে পুলিশি রাষ্ট্র? যদি পুলিশের ক্ষমতা হয়ে ওঠে অসীম? এবং তারা সেই ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার শুরু করে? তাহলে এই পুলিশ দিবসই হয়ে উঠতে পারে জনগণের জন্য পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার একটা উপলক্ষ্য। ঠিক সেটাই ঘটেছিল মিশরে।
২০১১ সালের আগের কয়েক বছরে মিশরে পুলিশি নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে ২০১০ সালের একটা ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে বছর জুন মাসে আলেক্সান্দ্রিয়ার এক ক্যাফে থেকে পুলিশ খালেদ সাঈদ নামে এক যুবককে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে। খালেদ সাইদের দোষ কী ছিল, সেটা কেউ পরিষ্কার জানত না। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরে দাবি করা হয়েছিল, পুলিশ তাকে গাঁজাখোর বা গাঁজা বিক্রেতা বলে সন্দেহ করেছিল।
কারণ যেটাই হোক, পুলিশ তাকে টেনে-হিঁচড়ে কাছের একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচে নিয়ে যায় এবং পেটাতে পেটাতে একপর্যায়ে মার্বেল পাথরের সিঁড়ির সাথে তার মাথা থেঁতলে দেয়। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত পুলিশ তাকে সেখানেই ফেলে রাখে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মোবাইল ফোন দিয়ে খালেদ সাঈদের রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবি তুলে ফেলে। এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ছবিটা পুরো মিশরে ভাইরাল হয়ে যায়।
খালেদ সাইদের মৃত্যুকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওয়ায়েল গনিম নামে এক মিশরীয় গুগল এক্সিকিউটিভ We are all Khaled Said নামে একটা ফেসবুক পেজ তৈরি করে। এই ঘটনাটা তখন ছিল খুবই অগুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। কিন্তু সপ্তাহ না গড়াতেই পেজটার ফলোয়ার সংখ্যা লাখের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পেজটা থেকে প্রায়ই পুলিশের নির্যাতন সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ পোস্ট করা হতো। ফলে ভুক্তভোগী মিশরীয় যুবকদের মধ্যে পেজটার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীতে ২০১১ সালে এই পেজটাই হয়ে ওঠে মিসরীয় আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দিক নির্দেশক এবং পেজটার ক্রিয়েটর ওয়ায়েল গনিমই হয়ে ওঠে মিসরীয় বিপ্লবের অন্যতম প্রধান সংগঠক।
২০০৯ এবং ২০১০ সালেও পুলিশ দিবসকে উপলক্ষ্য করে কিছু সংগঠন প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই কয়েক ডজনের বেশি মানুষ উপস্থিত হয়নি। এবং যারা উপস্থিত হয়েছিল, তারাও পুলিশের ধাওয়ার মুখে কয়েক মিনিটের বেশি রাস্তায় টিকতে পারেনি। কিন্তু ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস ছিল ভিন্ন। তিউনিসিয়ার গণআন্দোলনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ২৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে এপ্রিল সিক্স ইয়ুথ মুভমেন্টসহ বিভিন্ন সংগঠন জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে শুরু করে।
তাদের এসব প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠে ফেসবুক এবং ইউটিউব। “আমরা সবাই খালেদ সাইদ” পেজটাও তাদের ফলোয়ারদেরকে রাস্তায় নামার ডাক দেয়। তাদের দেওয়া লিঙ্কে ৯০ হাজার মানুষ ক্লিক করে জানান দেয়, ২৫ জানুয়ারি তারা মাঠে নামতে প্রস্তুত আছে। আয়োজকরা অবশ্য তখনও এত আশাবাদী ছিল না। প্রেসিডেন্টের পতন ঘটানো তো দূরের কথা, পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে এপ্রিল সিক্স ইয়ুথ মুভমেন্টের এক সংগঠক বলেছিল, তাদের স্বপ্ন ছিল, যদি কয়েক হাজার মানুষকেও তারা রাস্তায় নামাতে পারে, তাহলে তারা হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করতে পারবে।
কিন্তু মানুষ সেবার সত্যিই রাস্তায় নেমেছিল। কয়েক হাজার না। কয়েক লাখ। মিশরের জনগণ সত্যি সত্যিই পুলিশি নির্যাতনে অতিষ্ঠ ছিল। তিউনিসিয়ার বিপ্লব তাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এবং সঠিক সময় সঠিক একটা তারিখ তাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছিল – ২৫ জানুয়ারি। সেই তারিখে তারা রাস্তায় নেমেছিল প্রধানত পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করার জন্য। নিজেদের অধিকারের জন্য। কিন্তু তাহরির স্কয়ার যখন লোকে লোকারণ্য, তখন পুলিশের বাধার মুখে তাদের দাবি “আশ্শা’ব ইউরিদ এসক্বাত আন-নিজাম”-এ রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনি।
মিশরীয়দের বিপ্লব সফল হয়েছিল। তারা মোবারকের দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। তারা গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে পেরেছিল। কিন্তু ষাট দশক ধরে সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে থাকা একটা রাষ্ট্রে প্রতিটা প্রতিষ্ঠান যেভাবে এস্ট্যাবলিশমেন্টের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তার হাত থেকে মাত্র একটা বিপ্লবের মাধ্যমে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
যে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইসরায়েল মিশরের এই মিলিটারি এস্ট্যাবলিশমেন্টকে, ডীপ স্টেটকে পুনরায় ক্ষমতায় এনে বসিয়েছে, সেটাকে হয়তো বিপ্লবের ব্যর্থতা বলা যায়। কিন্তু সেটা মূলত প্রতিবিপ্লব। যে আশা নিয়ে জনগণ বিপ্লব করেছিল, প্রতিবিপ্লবের কারণে তা মিথ্যা হয়ে যায় না।
আরও পড়ুন: ১৭ই ফেব্রুয়ারির বিপ্লব: গাদ্দাফীর পতনের জানা-অজানা অধ্যায়
আরববসন্ত কি একদম ব্যার্থ হয়েছে?
এর কারণে কি কি সমস্যা হয়েছে আর কি বা পেয়েছি আমরা?