ইসলামপন্থীদের কৌশলগত সমস্যা

ইসলামপন্থীদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত হম্বিতম্বি করা। এটাকে সমস্যা বলছি এই কারণে যে এর ফলে বিরোধী শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, তারা সামরিক অভ্যুত্থানসহ অ্যান্টি-ইসলামিস্ট যেকোনো পদক্ষেপে সমর্থন দেয়।

দেখেন, যেকোনো স্বৈরশাসকের ক্ষমতা দখল করতে হলে বা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে মিনিমাম একটা জনসমর্থন দরকার হয়। না হলে সে টিকে থাকতে পারে না। এই জনসমর্থনটা বিভিন্নভাবে তৈরি হতে পারে। তার একটা হচ্ছে প্রতিপক্ষের ব্যাপারে আতঙ্ক বা ঘৃণা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। ইসলামপন্থীদের ক্ষেত্রে এই আতঙ্কটা অনেকক্ষেত্রে তাদের নিজেদের কারণেই সৃষ্টি হয়।

খিলাফতকামীদের কথা বাদই দিলাম; পলিটিক্যাল ইসলামিস্টদের কথাই ধরেন। আরব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে মুসলিম ব্রাদারহুড, অথবা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলাম। এদের পক্ষে কি ক্ষমতায় এসে এমন কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন করা সম্ভব, যার ফলে ইসলাম প্র্যাকটিস না করা মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা তৈরি হবে? সম্ভব না। কিন্তু এদের বিরোধীরা সেটাই প্রচার করে এবং এরা নিজেরাও সে ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান খুব একটা ক্লিয়ার করে না।

ইমেইলের মাধ্যমে নতুন পোস্টের আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে 40 জনের সাথে যোগ দিন।

ধরেন জামায়াত বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসল। এক্সাক্টলি কী কী পরিবর্তন হবে বলে আপনার মনে হয়? আপনাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বাধ্য করা হবে? নামাজের সময় হলে দোকান-পাট বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হবে? মেয়েদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা হবে? সিনেমা হলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে? টিভিতে নাচ-গান বা নাটক-সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হবে?

এগুলোর কোনোটাই হবে না। অতিরিক্ত অশ্লীলতা, অতিরিক্ত বেহায়াপনা টাইপের কিছু কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে হয়তো, কিন্তু সেটা খুব বেশি মানুষের মাথাব্যথার কারণ হবে না। কিন্তু এর বাইরে ড্রামাটিক কোনো পরিবর্তন হবে না। জাস্ট সমাজের কিছুটা ইসলামাইজেশন হবে। তারা যদি ক্ষমতা পাঁচ বছর পর্যন্ত টেকাতে চায়, বা পরবর্তীতে আবারও নির্বাচিত হতে চায়, তাহলে তাদের পক্ষে রাতারাতি বৈপ্লবিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভবই হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের মধ্যেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।

কিন্তু দেখবেন তাদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয় যে তারা ক্ষমতায় আসলে শিল্প-সাহিত্য সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সব স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যাবে, দেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে, প্রগতিশীল মানুষদেরকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। এবং তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারা এইটাকে খুব বেশি রিফিউটও করতে পারে না; কারণ তারাও ভান করে এবং দাবি করে, ক্ষমতায় গেলে তারা “ইসলাম কায়েম করবে”, “শরিয়া প্রতষ্ঠা করবে”।

এই “শরিয়া” জিনিসটাই অনেকের কাছে একটা আতঙ্কের নাম। কারণ শরিয়া বলতেই অনেকে বোঝে সৌদি আরব বা আফগানিস্তানের মতো শাসনব্যবস্থা। অর ওয়ার্স, আইএসের মতো শাসনব্যস্থা। ফলে সেক্যুলার-এলিট সমাজ, মিডিয়ার সাথে বা বিনোদনের সাথে যুক্ত মানুষজন শরিয়া নিয়ে এক ধরনের আতঙ্কে ভোগে।

এবং ইসলামিস্ট কেউ যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেজন্য চরম অগণতান্ত্রিক, চরম স্বৈরাচারকেও সমর্থন দেয়। স্বৈরাচারের ক্ষমতা দখলের জন্য যে মিনিমাম জনসমর্থনটুকু দরকার হয়, সেটা তৈরি করে। রাবা ম্যাসাকরে সমর্থন দেয়। শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ ওটাই – তাদের ভয়, হেফাজত ক্ষমতায় আসলে তাদের সব স্বাধীনতা নাই হয়ে যাবে, মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

বাস্তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হেফাজতের তো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নাই-ই; কিন্তু থিওরিটিক্যালি শুধু হেফাজত না, আরও কট্টর কেউও যদি ক্ষমতায় আসে, তার পক্ষে “শতভাগ” শরিয়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশ আফগান না, নাজদও না। এখানে শরিয়া প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটার রূপ ভিন্ন হবে। যদি আফগান স্টাইলের শরিয়া এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, সেটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। অন্তত নিকট ভবিষ্যতে তো না-ই।

আমার বিশ্লেষণমূলক লেখা যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে আমার এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন:

একটা জনপদে কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থা টেকসই হবে, সেটা সেই জনপদের শত বছরের ইতিহাস-সংস্কৃতি-রাজনীতির উপর নির্ভর করে। আফগানিস্তানে যে ছাত্ররা বিপ্লবে সফল হয়েছে, সেটা কি এমনি এমনি হয়ছে? হয়নি। তার পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেটা পরিষ্কারভাবেই বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন।

আফগানিস্তানে দুটো ফ্যাক্টর কাজ করেছে। প্রথমত, কাবুলের মতো শহরাঞ্চল বাদ দিলে, সেখানকার পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে সমাজ ঐতিহ্যগতভাবেই প্রচণ্ড রক্ষণশীল। ইনফ্যাক্ট আপনি যদি সেখানকার ইন ডিটেইল নিউজগুলো ফলো করেন, তাহলে দেখবেন, সেখানে যতগুলো বাহিনী আছে, যতগুলো ট্রাইবাল ফোর্স আছে, তার মধ্যে ক্ষমতাসীন ছাত্ররাই সবচেয়ে মডারেট।

দ্বিতীয়ত, সেখানে কমিউনিস্টদের ভয়াবহ দু:শাসন, কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা, এবং সোভিয়েতদের পতনের পর ওয়ারলর্ডদের জঙ্গুলে শাসন – সবকিছুই সেখানকার মানুষকে নতুন একটা বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করেছে। ফলে সেখানে বিকল্প শাসনের, অর্থাৎ শরিয়ার, যেটা তাদের ট্রাইবাল-রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার সাথে খুবই কম্পাটিবল, সেটার গ্রহণযোগ্যতা এবং সেটার প্রতি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের সাথে এর কোনোটা কি মেলে? মেলে না। সেজন্যই বাংলাদেশে শরিয়া প্রতিষ্ঠার মতো বাস্তবতা এখনও তৈরি হয়নি। যদি কেউ জোর করে শরিয়া প্রতিষ্ঠা করেও, সেটা টেকসই হবে না। তার পক্ষে “শতভাগ” শরিয়া আইন-কানুন প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। তাকে আইদার অনেক দিক থেকে মডারেট হতে হবে, অনেক কিছুতে ছাড় দিতে হবে, আর সেটা করতে না পারলে জনগণের বিদ্রোহে আর বিদেশের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে।

সেজন্যই বর্তমান পরিস্থিতিত শরিয়া প্রতিষ্ঠা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ককে আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় এবং কাউন্টার প্রোডাক্টিভ মনে হয়। কারণ আমরা এখনও পুরোপুরি স্বাধীনই হতে পারিনি।

এখনও সেনাবাহিনীতে, আমলাতন্ত্রে, গোয়েন্দা সংস্থায় আগের লোকজন, ভারতীয় স্বার্থ সংরক্ষণকারীরা বসে আছে। হাসিনার পক্ষে নিশ্চিতভাবেই আর ফিরে আসা আর সম্ভব না; কিন্তু ভারতীয় সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৃতীয় কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায় আসা যেকোনো মুহূর্তের ব্যাপার।

তৃতীয় বিশ্বের খুব দেশই আছে যারা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি প্রযোজ্য। অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রই স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, বিপ্লব করেছিল, ভোট দিয়ে পছন্দের দলকে নির্বাচিত করেছিল; কোনোটাই দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় হওয়া সম্ভবও না।

সেখানে বাংলাদেশর মতো একটা দেশ, যেটা ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত, যেটা দীর্ঘ সময় ভারতের উপনিবেশ ছিল, যেখানে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল, সেখানে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরাজ করবে – এটা আশা করাটাও বোকামি। ভারত আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেই, তাদের পছন্দের লোককে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করবেই, অথবা যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদেরকে হাত করার চেষ্টা করবেই – এটা মোটামুটি ইনেভিটেবল।

এরকম অবস্থায় শরিয়া-শরিয়া করে, অতিরিক্ত ইসলামাইজেশনের ভাইব প্রকাশ করে মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা মানুষজনকেও আতঙ্কিত করে দূরে ঠেলে দেওয়া, তাদেরকে অগণতান্ত্রিক শক্তির টুল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ না।

এরকম সময়ে আমাদের যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে যে ঐক্যের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করা। সেই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে সবগুলো ইনস্টিটিউশনকে সংস্কার করা, সব জায়গা থেকে বৈষম্য এবং ইসলামোফোবিয়ার ভূত ঝেঁটিয়ে বিদায় করা, পুরাতন লোকদেরকে সরিয়ে ইনস্টিটিউশনগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা; যেন নেক্সট টাইম ভারত চেষ্টা করলেও সহজে সবকিছুর দখল নিতে না পারে।

আমার সবগুলো বই


মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ ২ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার গল্পগুলো সিরিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদ

এটা শরিয়া চাওয়া-না চাওয়ার প্রশ্ন না। এটা স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন। আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পারি, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন ধরে রাখতে পারি, তাহলে এই ভূখন্ডের মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, ইসলাম বিকশিত হবে, আরও বেশি মানুষ ইসলামের কথা বলতে পারবে, চর্চা করতে পারবে।

কিন্তু স্বাধীনতা স্থায়ী হওয়ার আগেই যদি শরিয়া-খিলাফত নিয়ে ক্যাঁচাল করি, নাস্তিক-মুরতাদ ট্যাগ দিয়ে, পরোক্ষভাবে ভিন্নমতের ইসলামপন্থীদেরকেই হত্যার হুমকি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া মাতিয়ে রাখি, তাহলে নন-ইসলামিস্টদের মধ্যে যে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে, সেটা ভালো কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না।

আর যে ভারত মাত্র কয়েকমাস আগেও আমেরিকাকে কনভিন্স করে ফেলেছিল তৃতীয় অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনাকে মেনে নিতে, কারণ তা না হলে ইসলামিস্টরা ক্ষমতায় চলে আসবে, তারা যে এই ব্যাপারগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকাকে আবারও সিসির বাংলাদেশী ভার্সনকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে কনভিন্স করছে না, সেটা ভাবার কোনো কারণ নাই। বরং হঠাৎ করেই সব জায়গায় যেরকম অতি-ইসলামাইজেশন দেখা যাচ্ছে, সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট কারণ আছে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *