এলি কোহেন: দামেস্কে ইসরায়েলের ছদ্মবেশী গুপ্তচর
বিশ্ব রাজনীতি,  স্পাই স্টোরি

এলি কোহেন: দামেস্কে ইসরায়েলের ছদ্মবেশী গুপ্তচর

এলি কোহেন ছিলেন ইসরায়েলের বেস্ট স্পাইদের মধ্যে একজন।

এলি কোহেন ছিলেন মিসরীয় ইহুদী, কিন্তু তার বাবা ছিলেন সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে আসা। ফলে কোহেনের মিসরীয় এবং সিরিয়ান – উভয় ডায়ালেক্টের আরবির উপরেই ভালো দক্ষতা ছিল। ১৯৫৭ সালে মোসাদে যোগ দেয়ার পর কোহেনকে ধনী সিরিয়ান ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সিরিয়াতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেন তিনি ক্ষমতাসীন সিরিয়ানদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।

কোহেনের নতুন পরিচয় হয় কামেল আমিন সাবেত। তার কভার সাজানো হয় এরকম যে, তিনি মূলত আলেপ্পোর একজন ব্যবসায়ী, যিনি দীর্ঘদিন আর্জেন্টিনায় ব্যবসা করে এখন আবার সিরিয়াতে ফিরে এসেছেন। কভার স্টোরি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তাকে ১৯৬১ সালে বুয়েন্স আয়ার্সে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনি সমাজের উচ্চপদস্থ সিরিয়ানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এবং এরপর ১৯৬২ সালে সিরিয়াতে ফিরে গিয়ে তাদের রেফারেন্স সেখানকার ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে কামেল আমিন সাবেত তথা এলি কোহেন প্রায়ই তার বাড়িতে বিশাল বিশাল পার্টির আয়োজন করতেন। সেখানে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দেশের মন্ত্রীরাও উপস্থিত হতেন। কোহেন তাদেরকে নারী এবং মদ দিয়ে অর্ধচেতন করে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য আদায় করে নিতেন। তিনি মন্ত্রীদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদেরকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেন।

দাবি করা হয়, এ সময় তিনি সিরিয়ান জেনারেল এবং বাথ পার্টির সদস্য আমিন আল-হাফেজের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই আমিন আল-হাফেজই পরবর্তীতে ক্যু করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কোহেন আমিন আল-হাফেজের সাথে এতো বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যে, একপর্যায়ে আমিন তাকে নিজের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করার জন্যও বিবেচনা করেছিলেন।

এই দাবির পক্ষে অবশ্য শক্ত কোনো প্রমাণ মেলে না। সিরিয়ানরা এই দাবি অস্বীকার করে। আমিন আল-হাফেজ দাবি করেন, যে সময়ে তার সাথে এলি কোহেনের সম্পর্কের অভিযোগ করা হয়, সে সময় তিনি সিরিয়ায় বা আর্জেন্টিনায় ছিলেন না, বরং মস্কোতে ট্রেনিংয়ে ছিলেন। ইতিহাসবিদরাও এ দাবির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। ধারণা করা হয় ইসরায়েল মোসাদকে সুপার পাওয়ারফুল হিসবে প্রচার করার জন্যই এই দাবির উপর জোর দিয়ে থাকে।

যাই হোক, একটা সময় পর সিরিয়ানরা বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে একজন স্পাই আছে। সোভিয়েত টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে তারা দামেস্ক থেকে পাঠানো রেডিও সিগনাল ট্রেস করে এবং কোহেনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বিচার শেষে কোহেনের মৃত্যুদণ্ড হয়।

বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ধরা পড়া স্পাইদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ইসরায়েল ব্যতিক্রম। তারা কোহেনের ফাঁসি বাতিলের জন্য ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালায়। খ্রিস্টানদের পোপকে দিয়ে অনুরোধ করায়, ফ্রান্সকে দিয়ে হুমকি দেয়ায়। কিন্তু সিরিয়া সকল চাপকে অগ্রাহ্য করে কোহেনের ফাঁসি কার্যকর করে। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে জনসমক্ষে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তার মৃতদেহ ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেয়া হয়। বিশ্বের “শ্রেষ্ঠ” গোয়েন্দাসংস্থা মোসাদের জন্য এটা ছিল চূড়ান্ত হিউমিলিয়েশন।

ইসরায়েলি গুপ্তচর এলি কোহেনকে দামেস্কের রাজপথে ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃশ্য
ইসরায়েলি গুপ্তচর এলি কোহেনকে দামেস্কের রাজপথে ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃশ্য

তবে ধরা পড়ার আগে কোহেন তার নাম ইসরায়েলের ইতিহাসে লিখে রাখার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তার জেনারেল বন্ধুদের সাথে তিনি একবার গোলান হাইটস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে ধু-ধু মরুভূমির তীব্র গরমে দাঁড়িয়ে থাকা সিরিয়ান সৈন্যদেরকে তিনি “বুদ্ধি” দিয়েছিলেন, তাদের উচিত কিছু গাছ লাগিয়ে গাছের ছায়ায় বসে বসে বর্ডার পাহারা দেয়া।

নির্বোধ সিরিয়ানরা তার পরামর্শ অনুযায়ী সত্যি সত্যিই গাছ লাগিয়েছিল। সেই গাছগুলোই ছিল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ সিরিয়ার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সরাসরি সেই গাছগুলো লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে সহজেই সিরিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

এলি কোহেনকে নিয়ে নেটফ্লিক্স The Spy নামে ৭ পর্বের একটি সিরিয়াল নির্মাণ করেছে। সিরিয়ালে কোহেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত কোহেন – দ্য ডিক্টেটর খ্যাত সাচা ব্যারন কোহেন। তবে সিরিয়ালটা বিভিন্ন কারণে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ালটা নিয়ে আমার রিভিউ পড়তে পারেন এখান থেকে

এলি কোহেনকে নিয়ে আমার এই লেখাটি ফেসবুকের জনপ্রিয় গ্রুপ পাঠশালা – Centre for Basic Studies এর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সেরা লেখাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে নির্বাচিত এবং পুরস্কৃত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *