২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আটমাস ধরে পুরো লিবিয়া জুড়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি ছিল সিরত যুদ্ধ – গাদ্দাফির জন্মস্থান সিরতের জন্য যুদ্ধ। সিরতের মধ্যে যে এলাকাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো এক মাস পাঁচ দিন ব্যাপী যে এলাকাটিতে তুমুল যুদ্ধ চলেছে এবং যে এলাকাটিতে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফি আত্মগোপন করে ছিল, তার নাম রকম এতনিন (এরিয়া নাম্বার টু)। আর দুর্ভাগ্যবশত আমরা ছিলাম সেই রকম এতনিনের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জাফরানের অধিবাসী।
যুদ্ধের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তও আমরা হাজার হাজার মিসাইল, রকেট, মর্টার এবং লক্ষ লক্ষ রাউন্ড গোলাগুলির মধ্য দিয়েও সেই এলাকাতেই রয়ে গিয়েছিলাম। বাঁচব – এই আশা একেবারেই ছিল না। কিন্তু সম্ভাব্যতার সকল সূত্রকে ভুল প্রমাণিত করে শেষ পর্যন্ত আমরা বেঁচে গেছি।
মুভির মধ্যে ওয়ার জঁনরাটা আমার সবচেয়ে ফেভারিট। দ্য পিয়ানিস্ট, সেভিং প্রাইভেট রায়ান, শিন্ডলার্স লিস্ট, হোটেল রুয়ান্ডা, ব্রাদারহুড অফ ওয়ারসহ দেশ-বিদেশের সেরা সেরা যুদ্ধের অধিকাংশ মুভিই আমার দেখা। কিন্তু যে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি, তা নিঃসন্দেহে যেকোনো সিনেমাকে হার মানায়।
যে ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে ঘটে গেছে, ভালো কোনো ঔপন্যাসিকের হাতে পড়লে সেগুলো দিয়ে একটা কালজয়ী মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব। কিংবা ভালো পরিচালকের হাতে পড়লে সেগুলো দিয়ে অস্কারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো একটা চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলাও অসম্ভব কিছু না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেরকম লেখনী বা পরিচালনা, কোনো প্রতিভা নিয়েই আমার জন্ম হয়নি। তাই আপাতত এই যুদ্ধে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিখেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
বিদ্রোহের শুরুর দিকে সিরত
যুদ্ধের প্রথম দিকে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে সিরতের পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক ছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, লিবিয়াতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ১৫ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি বেনগাজিতে বিদ্রোহ শুরু এবং আল জাজিরাতে এ সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হলে তার প্রতিবাদে সর্বপ্রথম সিরতে গাদ্দাফির পক্ষে মিছিল বের হয় এবং সিরত গাদ্দাফির জন্মস্থান হওয়ায় স্বভাবতই সিরতের আপামর জনসাধারণ সেই মিছিলে ভেঙ্গে পড়ে।
কিন্তু ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি বেনগাজি এবং আল-বেইদার নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মিছিলগুলোতে নিরাপত্তাবাহিনী গুলি করার পর এবং তাদের উপর ভাড়াটে আফ্রিকান মার্সেনারিদের লেলিয়ে দেওয়ার পর যখন ১৯ তারিখে বেনগাজির সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ পদত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয় এবং মাত্র তিন ঘণ্টার যুদ্ধে আর্মি হেডকোয়ার্টার দখল করে বেনগাজিকে কার্যত স্বাধীন করে ফেলে, তখন থেকেই পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
১৭ই ফেব্রুয়ারি পাঁচ-ছয়টা মিলিটারি জীপ এসে আমাদের বাসার পেছনের আফ্রিকানদের মেসগুলো থেকে দশ-পনের জন আফ্রিকানকে ধরে নিয়ে যায়। এদের প্রায় সবাই ছিল লিবিয়ান নাগরিকত্ব পাওয়া চাদিয়ান এবং মৌরতানিয়ান শ্রমিক। পরবর্তীতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে, তাদেরকে বিদ্রোহ দমন করার জন্য বেনগাজিতে পাঠানো হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ রাত একটার দিকে গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম টিভিতে ভাষণ দেয় এবং বিদ্রোহ না থামলে কাবিলা কাবিলায় (গোটেগোটে) যুদ্ধ বেঁধে, নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি করে লিবিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে বলে হুঁশিয়ার করে দেয়। এই ভাষণের পরপরই সিরতের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। পুরো শহরের সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ শুধু বস্তায় ভরে ভরে ব্যাংক থেকে টাকা-পয়সা এবং স্বর্ণ-গয়না তুলে বাসায় নিয়ে যেতে থাকে।
মাত্র একদিনে সবগুলো দোকানপাট খালি হয়ে যায়। রাস্তায় শুধু পাংশু মুখের মানুষদের ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালিয়ে ছোটার দৃশ্য ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্য নেই। গৃহযুদ্ধের আশংকায় মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটেই পাড়ি দিতে হয়। দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ, কারো সাথে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমরাও সিরত বাংলাদেশী স্কুল অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে গাদ্দাফি ভাষণ দেন। গাদ্দাফি তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আল কায়েদার ষড়যন্ত্র এবং নেশাগ্রস্ত যুবকদের নেশার ঘোরে করা কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। যারা তাকে পছন্দ করে, তাদেরকে লিবিয়ার বেত-বেত (প্রতিটা ঘর), দ্বার-দ্বার (প্রতিটা দরজা), জাঙ্গা-জাঙ্গা (প্রতিটা ইঞ্চি) মুক্ত করার জন্য অভিযান চালানোর আহ্বান জানান।
এর কদিন পরই গাদ্দাফি আরেকটা ভাষণ দেন এবং তার পরপরই লিবিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারগুলো গাদ্দাফি-সমর্থকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সিরতের ষোল বছরের বেশি বয়সী প্রতিটা মানুষের হাতে হাতে রাশিয়ান কালাশনিকভ রাইফেল দেখা যেতে থাকে। কারণে অকারণে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মানুষ আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করতে থাকে। অস্ত্রের প্রভাবে এসময় ছিনতাই এবং বিদেশীদের উপর হয়রানির ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। প্রচুর বাংলাদেশীও ছিনতাই এবং হয়রানির কবলে পড়ে।
আন্দোলনের শুরুতেই বেনগাজির ইন্টারনেট কানেকশন কেটে দেওয়া হয়েছিল, মার্চের ৪ তারিখে পুরো লিবিয়াতেই নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। মার্চের ১৯ তারিখে যখন বেনগাজির বিদ্রোহীদের দমনের জন্য, গাদ্দাফি-সমর্থকদের ভাষায় দেশকে জেরদানদের (ইঁদুর) হাত থেকে নাদ্দাফ (পরিষ্কার) করার জন্য গাদ্দাফির কয়েকশত ট্যাংক প্রায় বেনগাজির কাছাকাছি পৌঁছে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্রেঞ্চ যুদ্ধবিমান বেনগাজিতে গাদ্দাফি-বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে।
প্রায় একইসাথে শুরু হয় আমেরিকার অপারেশন অডিসি ডন। প্রথম রাতেই ১১০টা টমাহক ক্রুজ মিসাইল মেরে লিবিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এর কয়দিন পরেই মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহর থেকে সিরতে প্রথমবারের মতো টমাহক মিসাইল মারা হয়।
সেদিন ভোর চারটার দিকে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে এবং কম্পনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি ঘরের সবাই চিৎকার, ছুটাছুটি করছে। আম্মু চিৎকার করে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে বলল। পুরানো বাড়ি, কম্পনের সাথে ভেঙ্গে পড়তে পারে। বের হওয়ার আগেই শোঁ … করে একটা শব্দ হলো আট-দশ সেকেন্ড ধরে, এরপরই ধড়াম করে পুরো দুনিয়া কাঁপিয়ে একটা মিসাইল এসে পড়ল।
প্রচণ্ড ধাক্কায় বেডরুমের কাঠের জানালাটা খুলে গেল, ছাদ থেকে প্লাস্টার এবং ধুলোবালি খসে খসে ঘরের মেঝেতে পড়তে লাগলো, আমার রুমের ছাদের টিনগুলো কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে উপরে-নিচে কাঁপতে লাগলো, সিলিং ফ্যানটা এলোপাথাড়ি ঘুরতে লাগলো। হুড়মুড় করে সবাই বেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। এর পরপরই আরো তিনটা মিসাইল এসে একই জায়গায় পড়ল – আমাদের বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে সাবা’ মিয়া (সেভেন হান্ড্রেড হাউজিং এরিয়া) নামক এলাকায়।
প্রতিটা মিসাইল পড়ার আগে শোঁ … করে শব্দ হয়, সেই শব্দের সাথে সাথে বুকের ভেতরে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। আমরা শক্ত করে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, এর মধ্যেই শোঁ শব্দ হতে হতে পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে, আর তার পরপরই পৃথিবী কাঁপিয়ে মিসাইল মাটিতে এসে পড়ে। প্রতিটা মিসাইল পড়ার সাথে সাথে গরম বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগে, আর আমরা মাথা নিচু করে বসে পড়ি।
বাসার সামনের গলিতে কান্নাকাটির শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি দক্ষিণ দিকের রাস্তার পাশের বাসাগুলোর লিবিয়ান বুড়ি, মহিলা এবং বাচ্চাকাচ্চারা দৌড়ে দৌড়ে উত্তরে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। সবার হাতে একটা করে ব্যাগ। কে জানে, হয়তো এই ব্যাগের ভেতরেই তাদের টাকাপয়সা, স্বর্ণ-গয়না, সারা জীবনের সঞ্চয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নাকে পোড়া গন্ধ আসতে লাগলো। এর মধ্যেই মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি আসতে লাগলো। ফজরের সময় এখনও হয়নি, কিন্তু ইমাম শেখ মাহমুদ এই ভোরেই মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য মসজিদে ছুটে গেছেন। বিন হাম্মাল মসজিদটা রাস্তার অন্যপাশে, সাবা মিয়ার কাছাকাছিই অবস্থিত। সেখান থেকে প্রায় এক ঘণ্টা পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন ক্রুসেডরদের হামলার নিন্দা জানিয়ে পাঠ করা খুতবার আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো।
সকাল দশটা পর্যন্ত গোলাবারুদের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। সাবা মিয়াতে বেশ কিছু অস্ত্রভাণ্ডার ছিল। বোঝা গেল মিসাইলগুলো সেখানেই মারা হয়েছিল। পরদিন সারা দিন আমরা সবাই প্রচণ্ড মাথা ব্যথা নিয়ে কাটালাম। এক কিলোমিটার দূরে পড়া মিসাইলেই সবার মাথা ধরে গেছে, কাছে পড়লে কি হবে কে জানে?
প্রথম দুই সপ্তাহে সিরতে আরও কিছু ভয়াবহ বিমান হামলা হলো। এরমধ্যে একটা ছিল সমুদ্রের পাড় থেকে ন্যাটোর প্লেন লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের উপর বিমান আক্রমণে তিনটা ছেলের মৃত্যু। প্রথম প্রথম ন্যাটো প্রায় সারাদিনই উড়ত। কিন্তু আক্রমণগুলো শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটি এবং অস্ত্রভাণ্ডারগুলোতেই হতো। সাধারণ মানুষের উপরে এর তেমন কোনো প্রভাই পড়ত না।
একেবারে প্রথম দিকে ন্যাটোর বিমানের আওয়াজে ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে সেগুলো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মে-জুন-জুলাই মাসের দিকে সিরতে ন্যাটো একেবারেই উড়ত না। তখন সিরতের মানুষের পক্ষে বোঝাই সম্ভব ছিল না, লিবিয়ার অন্যান্য এলাকায় কিরকম ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে!
এরমধ্যে মিসরাতা, জাওইয়া, জিনতান, ব্রেগা-আজদাবিয়া প্রভৃতি ফ্রন্ট-সহ প্রায় পুরো লিবিয়ায় যুদ্ধ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন শহরের দখল বেশ কয়েকবার করে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু গাদ্দাফি-সমর্থকদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি সিরতে তার আঁচড়টুকুও লাগে নি।
এই সুযোগে সিরতে গাদ্দাফি সমর্থকরা এবং তাদের মিডিয়াগুলো প্রচার করতে থাকে, সিরত এবং ত্রিপোলি যেরকম স্বাভাবিক, অন্যান্য শহরেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, শুধু বেনগাজি ছাড়া পুরো লিবিয়া গাদ্দাফির নিয়ন্ত্রণে। টিভিতে যা দেখানো হয়, তার সবই মিডিয়ার কারসাজি, স্টুডিওতে শ্যূট করা এবং এডিট করা ভিডিও। বেনগাজিরও বেশিরভাগ মানুষ গাদ্দাফিকে চায়, আর দু-এক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী বেনগাজিতে ঢুকে যাবে।
যুদ্ধের মাঝামাঝির দিনগুলোতে সিরত
সিরতের পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে মূলত রোজার মাস থেকে। বিদ্রোহীরা মিসরাতা, জিনতান, নাফূসা মাউন্টেইনসহ বিভিন্ন এলাকার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে এবং গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েগুলো দখলে নিয়ে নেয়, যার ফলে সিরতের সাথে ত্রিপোলির যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়ে। দোকান-পাট গুলো খালি হতে শুরু করে, পেট্রোলের অভাবে রাস্তায় ট্যাক্সি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি, গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংকটও শুরু হয়।
রোজার মাঝামাঝি সময়ে আমাদের গ্যাস শেষ হয়ে যায় এবং আমরা মাটির চুলা তৈরি করে কাঠ দিয়ে রান্না করতে শুরু করি। শেষের দিকে অবশ্য শহরে কাঠেরও সংকট শুরু হয়। মানুষ মাজরায় (ফার্মে) গিয়ে আস্ত গাছ উপড়ে নিয়ে আসতে শুরু করে। এ সময় দুই-তিন দিন পরপর দুই-তিন ঘণ্টা করে কারেন্ট দেওয়া হতো। অথচ এর আগে সারা জীবনে লিবিয়াতে মোট কত ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না, সেটাও হাতে গুনে বলে দেওয়া যেত।
গাদ্দাফির পক্ষের মিডিয়ার দাবি ছিল, বিদ্রোহীরা পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দেওয়ার কারণে কারেন্ট নেই। কিন্তু এটা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। কারণ বিদ্রোহীরা ইচ্ছে করলে পানির সাপ্লাইও কেটে দিতে পারত। বরং গাদ্দাফি বাহিনী নিজেরাই ইচ্ছে করে কারেন্ট বন্ধ করে রাখত যেন মানুষ আল-জাজিরা, আল-অ্যারাবিয়া দেখে দেশের প্রকৃত অবস্থা (অধিকাংশ এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে) জানতে না পারে – এটা আরও অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ছিল।
রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্রোহীরা জিলিতন, জাওইয়া, সোরমান, গারিয়ান প্রভৃতি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং একই সাথে তিনটা ফ্রন্ট থেকে ত্রিপোলির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রমজান মাসের ২০ তথা আগস্টের ২০ তারিখে, যেদিন জাওইয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধারা ত্রিপোলি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়, সেদিন রাতে ত্রিপোলির জায়গায় জায়গায়, বিশেষ করে তাজুরা এবং সুক্ব আল-জুমায় মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে।
বিদ্রোহ দমন করতে সচেষ্ট গাদ্দাফি-বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে ন্যাটো। এদিন রাতে গাদ্দাফির মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিম সংবাদ সম্মেলনে বলে, ত্রিপোলি দখল করা অসম্ভব কারণ গাদ্দাফির অনুগত ৬৫,০০০ সৈন্য এবং সশস্ত্র সাধারণ জনগণ ত্রিপোলি রক্ষা করবে।
কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। পরদিন ২১ তারিখে বিদ্রোহীরা ত্রিপোলি আক্রমণ করে এবং অকল্পনীয়ভাবে প্রায় বিনা বাধায় মাত্র এক রাতের মধ্যে ত্রিপোলি দখল করে ফেলে। আগের দিন রাতেও লিবিয়ান টিভি থেকে গ্রিন স্কয়ারে গাদ্দাফির সমর্থকদের উৎসব দেখানো হচ্ছিল, অথচ ২১ তারিখ রাতে দেখা গেল গ্রিন স্কয়ার সম্পূর্ণ বিরোধীদের দখলে। তাদের কমান্ডার আব্দুল হাকিম বিলহাজ সেখানে দাঁড়িয়ে আল-জাজিরার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিচ্ছে।
গ্রিন স্কয়ার দখলের পরদিন ২২ তারিখে বিদ্রোহীরা টিভি সেন্টার এবং মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো দখল করে নেয় এবং সাথে সাথেই সবাইকে ৫০ দিনার (প্রায় ৩০০০ টাকা) করে উপহার দেয়, দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধ থাকার পর ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দেয় এবং “গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সবাইকে অভিনন্দন” এই জাতীয় একটা এসএমএস পাঠায়। এই এসএমএস মোবাইলে আসা মাত্রই গাদ্দাফি-বাহিনী সিরতের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়।
ত্রিপোলি দখলের পরপরই বিদ্রোহীরা নজর দেয় গাদ্দাফির দখলে থাকা অবশিষ্ট শহরগুলো অর্থাৎ সিরত, সাবহা এবং বানিওয়ালিদের উপর। এরমধ্যে সিরত ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সিরত হচ্ছে কোস্টাল হাইওয়ের উপর অবস্থিত। ত্রিপোলি বা মিসরাতার সাথে বেনগাজির যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এই কোস্টাল হাইওয়ে।
রোজার ঈদের পরপরই বিদ্রোহীরা বানিওয়ালিদ আক্রমণ করে। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ রাত ঠিক বারোটার সময় বিদ্রোহীরা বানিওয়ালিদ শহরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ঠিক যে মুহূর্তে আল জাজিরা এই সংক্রান্ত ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করে, তার পাঁচ মিনিট পরেই সমগ্র সিরতের বিদ্যুৎ সংযোগ চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গ্যাস, ইন্টারনেট, ফোন আগে থেকেই বন্ধ ছিল। এবার কারেন্টও গেল। আমরা শুধু আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছিলাম পানিটা যেন না যায়।
আমার সবগুলো বই
সিরত যুদ্ধ – ব্যাটল ফর সিরত
ঈদের পর থেকেই জাজিরা-আরাবিয়ার সংবাদে “মা’আরাকাত সের্ত” এবং বিবিসি-সিএনএনের সংবাদে “ব্যাট্ল ফর সির্ত” নামে বিশেষ পরিক্রমা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে বিদ্রোহীদের এতো তাড়াতাড়ি সিরত আক্রমণ করার ইচ্ছে ছিল না। এর আগে অন্তত তিনবার সিরতের কাছাকাছি এসে প্রচণ্ড মার খেয়েছিল তারা।
তাই সিরতের দুই দিকেই সত্তর কিলোমিটার দূরে ঘাঁটি গেঁড়ে সিরতবাসীকে আত্মসমর্পণের জন্য দেওয়া সময় বার বার বৃদ্ধি করে তারা অবশ্যম্ভাবী একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়াতে চাইছিল। তাদের চেষ্টা কতটুকু সফল হতো বলা মুশকিল, কিন্তু এর মাঝেই সেপ্টেম্বরের ১০ বা ১১ তারিখে সিরতে এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, যার ফলে পুরো যুদ্ধ সম্পূর্ণ নতুন একটা গতিপথ পেল।
সিরতের রকম ওয়াহেদ (এরিয়া নাম্বার ওয়ান) নামক এলাকার অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল মিসরাতি কবিলার (গোত্রের) অন্তর্ভুক্ত এবং স্বভাবতই তারা ছিল গাদ্দাফি-বিরোধী। কিন্তু সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা এতদিন নিশ্চুপ ছিল। তাদের অনেকে এমনকি মিছিলে সবুজ পতাকা নিয়ে গাদ্দাফি-সমর্থকদের প্রধান শ্লোগান “আল্লাহ্, মোয়াম্মার, ওয়া লিবিয়া, ওয়া বাস” অর্থাৎ “আল্লাহ, গাদ্দাফি অ্যান্ড লিবিয়া, অ্যান্ড দ্যাটস অল” শ্লোগান পর্যন্ত দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেকেই গোপনে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল।
এরকম একটি পরিবার ছিল সাফরুনি পরিবার। খবর পেয়ে গাদ্দাফি বাহিনী সাফরুনিকে গ্রেপ্তারের জন্য যায়। ধরা খাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু, তাই সে ধরা না দিয়ে বিদ্রোহীদের চাঁদ-তারা খচিত তিন বর্ণের পতাকা নিয়ে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় গোলাগুলি। সাফরুনির পুরো বাড়ি রকেট লঞ্চার দিয়ে ধসিয়ে দেওয়া হয়। সে এবং তার এক ছেলে মারা যায়। গাদ্দাফির পক্ষের মারা যায় আরও পাঁচজন।
গোলমালটা বাঁধে সাফরুনির ছেলেকে নিয়ে। সে মারা গিয়েছিল ধারণা করে তাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু লাশ গোসল করানোর জন্য বের করতে গিয়ে দেখা যায় যে, সে আসলে তখনও মরেনি। এই খবর কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং মিডিয়া তার স্বভাব অনুযায়ী ফুলিয়ে -ফাঁপিয়ে জীবন্ত মানুষকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখার মতো এই অমানবিক ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে। এর ফল হিসেবে মিসরাতার ক্ষিপ্ত বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরত আক্রমণের জন্য দলে দলে এসে জমা হতে থাকে।
১৩ই সেপ্টেম্বর প্রথম আমরা একটু ভিন্ন ধরনের শব্দ পেলাম। এর আগে ন্যাটো যখন অনেক দূরে কোথাও বোমা ফেলত, তখন শব্দ যতটুকু হতো, সেই তুলনায় মাটি এবং ঘরের দরজা-জানালা কেঁপে উঠত অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রথম আমরা অনেক দূর থেকে ধুপ-ধাপ জাতীয় এক ধরনের প্রতিধ্বনির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু কোনো কম্পন অনুভব করছিলাম না।
আমাদের অনেকেরই ধারণা হলো এবং মাত্র কয়েকজন লিবিয়ান স্বীকার করল, এগুলো ট্যাংক, মর্টার এবং আরপিজির (রকেট প্রপেলিং গ্রেনেড) আওয়াজ। বিদ্রোহীরা সিরতের পশ্চিম দিকে জারফের ভেতর দিয়ে চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে।
কিন্তু সিরত রেডিও এবং সাধারণ লিবিয়ানদের মুখে তখনও তাদের সেই ক্লাসিক্যাল সুর। এগুলো লিবিয়ান সেনাবাহিনীর (গাদ্দাফি-বাহিনী) অনুশীলনের আওয়াজ। বিদ্রোহীরা সিরতের কাছাকাছি আসার প্রশ্নই উঠে না। কারণ সিরতে গাদ্দাফির ২০,০০০ সৈন্য আছে। তাছাড়া লিবিয়ার সব জনগণই তো গাদ্দাফিকে চায়! বিদ্রোহীরা মূলত তালেবান এবং কাতার ও আরব আমিরাতের সৈন্য, তারা সংখ্যায় খুবই কম।
সিরতে ঢুকবে কি, মিসরাতাই তো এখন আর তাদের দখলে নেই! সিরতের দিকে যখন এগুচ্ছিল, তখন লিবিয়ান সৈন্যরা দক্ষিণ দিকের সাহারা থেকে আক্রমণ করে মিসরাতা দখল করে ফেলেছে! একদিকে মিসরাতা পর্যন্ত এবং অন্যদিকে ব্রেগা পর্যন্ত গাদ্দাফির দখলে! আর এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরা লিবিয়া গাদ্দাফির দখলে চলে আসবে!
১৪ই সেপ্টেম্বর একটু শান্ত ছিল। কিন্তু ১৫ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই মর্টারের শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে। সকালে আমি, আমার খালাতো ভাই শাওন, আমাদের প্রতিবেশী ইয়াসিন এবং শাকের সমুদ্রে গিয়েছিলাম মাছ ধরার জন্য। গত কয়েকমাস ধরে বাজারে কোনো মাছ নেই। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ডিম নেই, মুরগীও নেই প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে। মাছ অবশ্য পাই নি, কিন্তু সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বিদ্রোহীরা নাকি সিরতের বিশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে।
বাসায় ফিরে এসে দেখি আমার ছোট ভাই তালহা ঘরে নেই। সে বাড়িওয়ালা কামালের ভাই মোত্তালেবের সাথে কুশায় (বেকারি) গেছে খুবজা কিনতে (মানচিত্রে ২ চিহ্নিত)। কুশাটা সিরত শহরের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, জাজিরাত জাফরানের (জাফরান চত্বরের) সাথেই (মানচিত্রে ১ চিহ্নিত)। বিদ্রোহীরা ঐদিক দিয়েই আসছে। মর্টারের আওয়াজ যত জোরালো হয়ে উঠতে লাগলো, তালহার জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা তত বাড়তে লাগলো।
বিকেল চারটার দিকে যখন রাস্তার দিক থেকে কান ফাটানো শব্দ হতে লাগলো, ঠিক তখনই ধুলো ছিটিয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে মোত্তালেব গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রেক করল এবং হাঁপাতে হাঁপাতে তালহা গাড়ি থেকে নেমে এলো। তারা মাত্র নেমেছে, আর সাথে সাথেই রাস্তার দিকে মর্টার শেল এসে পড়তে লাগলো।
তালহার মুখ থেকে যা শুনতে পেলাম তা হচ্ছে, তারা যখন কুশায় খুবজার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন প্রথমে একজন লোক এসে খবর দেয় যে, বিদ্রোহীরা ২৩ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। তার পাঁচ মিনিট পরেই আরেকজন এসে বলে বিদ্রোহীরা ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত এসে গেছে, সবাই যেন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যায়। লোকজন তার কথা বিশ্বাস না করে তাকে ধমকে ভাগিয়ে দেয়।
কারণ সবাই গাড়ির রেডিওতে সিরত রেডিও শুনছিল। সেখানে বলা হচ্ছিল, পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে যুদ্ধ হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবীরা যেন তাদের গাড়ি এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যায়। গাড়িতে বেশি পেট্রোল না থাকলেও সমস্যা নেই, ত্রিশ কিলোমিটার দূরের একটি ফিলিং স্টেশনে ফ্রি পেট্রোল দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় লোকটা চলে যেতে না যেতেই হঠাৎ কান ফাটানো শব্দ হতে থাকে এবং গাদ্দাফির সৈন্যরা শহরের বাইরের দিক থেকে ফিরে এসে কুশার সামনের জাফরানের গোল চত্বরে মেশিনগান এবং মিসাইল লঞ্চার ফিট করে পজিশন নিয়ে সামনের দিকে ফায়ার করতে শুরু করে।
সাথে সাথে সবাই দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পালাতে শুরু করে। তালহা জোরে চিৎকার করে কথা বলছিল কিন্তু আমরা সেটাও ঠিকমতো শুনতে পারছিলাম না। কারণ ততক্ষণে আমাদের সামনের গলিতে পজিশন নিয়ে গাদ্দাফি-বাহিনী রাস্তার দিকে মেশিনগান থেকে ফায়ার শুরু করে দিয়েছে। অর্থাৎ বিদ্রোহীরা শহরে ঢুকে পড়েছে!
বৃহস্পতিবারের সেই বিকেল ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলোর মধ্যে একটা। কান ফাটানো শব্দ করে একটার পর একটা মিসাইল এসে আশেপাশে পড়ছে। উপর দিয়ে ন্যাটো প্রচণ্ড শব্দ করে বিরামহীনভাবে উড়ছে। গাদ্দাফি-বাহিনীর মেশিনগান অবিরত বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমরা হঠাৎ অনেক মানুষের মিছিলের মতো আনন্দধ্বনি শুনতে পেলাম।
আমাদের বাসার উত্তরে সমুদ্রের পাড় দিয়ে নতুন একটা রাস্তা গিয়েছে যেটা সমতল থেকে বেশ উঁচু, সেই রাস্তা দিয়ে বিদ্রোহীরা শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল (মানচিত্রে উপরের দিকে যাওয়া নীল রংয়ের তীর চিহ্নিত দাগ)। এর মধ্যে হঠাৎ গাদ্দাফি কবিলার কয়েকটা ছেলে এসে আমাদের বাসার ঠিক সামনে থেকে (মানচিত্রে ৩ চিহ্নিত) আড়াল নিয়ে বের হয়ে সেই রাস্তা লক্ষ্য করে (মানচিত্রে ৪ চিহ্নিত) একটা আরপিজি মারল। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেল এবং ছেলেগুলো এই ফাঁকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। বিদ্রোহীরা সেই রাস্তা ধরে আর না এগিয়ে পিছু ফিরে গেল। কিন্তু সেখান থেকে তারা শহরের উপর এলোপাথাড়ি মেশিনগানের গুলি আর মিসাইল মারতে লাগলো।
আমরা এবং বাড়িওয়ালারা আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে সামনে বাড়িওয়ালার ভাই হামজা নতুন বাড়ি বানাচ্ছিল, সেখানে আশ্রয় নিলাম। বাড়িটাতে এখনও দরজা-জানালা লাগানো হয় নি, কিন্তু এর ছাদটা তুলনামূলকভাবে একটু মজবুত। তাই মিসাইল পড়লে হয়তো একটু কম ভাঙবে। এরমধ্যেই ন্যাটো হঠাৎ একটা বোমা মারল আমাদের বাসা থেকে এক থেকে দেড়শ মিটারের মধ্যে (মানচিত্রে ৬ চিহ্নিত)। প্রচণ্ড শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে গেল। মনে হলো পুরো ঘর যেন ভেঙ্গে মাথার উপর পড়ছে। কিন্তু না, পুরানো প্লাস্টার খসে পড়ে ছাড়া আর কিছু ঘটল না।
এই গোলাগুলির মধ্যেই আমাদের বাড়িওয়ালা কামাল তার যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, অর্থাৎ আট-দশটা কালাশনিকভ রাইফেল, একটা স্নাইপার রাইফেল, তিনটা রকেট লঞ্চার বস্তায় ভরে মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে ফেলল। কামাল নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো একটা পদে চাকরি করত। প্রায়ই সে অস্ত্র নিয়ে ব্রেগা, রাসলানুফ প্রভৃতি শহরে গাদ্দাফির যোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে যেত। কিন্তু আজ যখন একেবারে ঘরের সামনে যুদ্ধ চলছে, সে তখন সব অস্ত্র মাটিচাপা দিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে তার স্ত্রী মাস্তুরার পাশে বসে আছে। তার মেজো ছেলে মেহেদী, যে সবচেয়ে দুরন্ত, সে এই গোলাগুলি সহ্য করতে না পেরে একটানা কেঁদে চলছে আর একটু পরপর জিজ্ঞেস করছে, কখন এই গোলাগুলি শেষ হবে?
সেদিন শহরের ভেতর যুদ্ধ মাত্র দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। সন্ধ্যার সাথে সাথেই বিদ্রোহীরা ফিরে গেল। কিন্তু রেখে গেল একটি শহরের ধ্বংসস্তূপ। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে। আমাদের গলি থেকে বেরুলে রাস্তার উপরেই যে ফার্নিচারের দোকান, সেটায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেছে। আমাদের নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য শুনলাম গাদ্দাফি-বাহিনী রাস্তায় মিছিল বের করেছে। তাদের দাবি, তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে জেরদান অর্থাৎ ইঁদুরগুলোকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে! এটা তাদের মহা বিজয়!
রাতের বেলা আমাদের প্রতিবেশী নবী স্যার এবং ইয়াসিনের আব্বা রমজান আঙ্কেল আসলো আমাদের বাসায়। রমজান আঙ্কেল কাঁদছেন, কারণ তার ছোট মেয়ে খাদিজা পায়ে গুলি খেয়েছে। ঘরের দেয়াল ভেদ করে মেশিনগানের সাড়ে বারো মিলিমিটার গুলি এসে তার পায়ে ঢুকেছে। (রমজান আঙ্কেলদের বাসা মানচিত্রে ৫ চিহ্নিত অংশে)।
ঐ মুহূর্তে হসপিটালে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাই রমজান আঙ্কেল নিজেই ব্লেড দিয়ে উরুর মাংস কেটে এরপর প্লায়ার্স দিয়ে টেনে বুলেটটা বের করেছেন। পরে যুদ্ধ থামার পর নবী স্যারের গাড়িতে করে ইবনে সিনা হসপিটালে নিয়ে গেছেন। হসপিটালে গিয়ে তারা শুনেছেন, তখন পর্যন্ত সেখানে দেড়শ লাশ নেওয়া হয়েছে।
আজকের মতো যুদ্ধ শেষ হয়েছে। গাদ্দাফি বাহিনী যতই দাবি করুক, তারা বিদ্রোহীদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমরা তো দেখেছি আসলে তারা তেমন কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনি। বিদ্রোহীরা এসেছে, দেখেছে এবং মেরেছে। আজ হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তারা চলে গেছে। কিন্তু কাল তো আবার আসবে! সিরতের তথাকথিত ২০,০০০ সৈন্যের ব্যূহ ভেদ করে একবার যেহেতু তারা ঢুকতে পেরেছিল, আবারও পারবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে কতদিন এভাবে আসবে আর আক্রমণ করে চলে যাবে? এতদিন আমরা শুধু দোয়া করতাম বিদ্রোহীরা সিরতে আসে না কেন, এসে দখল করে ফেললেই তো শেষ হয়ে যায়! কিন্তু একবেলার এই যুদ্ধ দেখে এখন মনে হচ্ছে, বিদ্রোহীরা না এলেই বুঝি ভালো হতো!
১ম পর্ব: ব্যাট্ল ফর সিরত, ২য় পর্ব: বিদ্রোহীদের কবলে, ৩য় পর্ব: গন্তব্য অজানা, ৪র্থ পর্ব: নরকে প্রত্যাবর্তন, ৫ম পর্ব: মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, ৬ষ্ঠ পর্ব: দ্বিতীয় জীবন, ৭ম পর্ব: বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে, ৮ম পর্ব: প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন