শুক্রবারের পুরো দুপুর এবং বিকেল আমরা না খেয়ে কাটালাম। মাস্তুরার (বাড়িওয়ালা কামালের স্ত্রী) মায়েরা এমনিতেই গরীব, তাছাড়া গত চার মাস ধরে তাদের উপর বসে বসে খাচ্ছিল মাস্তুরার মামাতো ভাই আ’ত হারাগাদের একটা বিশাল পরিবার এবং তাদের প্রতিবেশী বুসেফিদের পরিবার, যারা মিসরাতা যুদ্ধের সময় মিসরাতা থেকে সিরতে পালিয়ে এসেছিল।
সন্ধ্যার সময় খাবার দিল, কিন্তু তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কুসকুসি, কোন মাংস বা তরকারি ছাড়াই। অবশ্য কারেন্ট না থাকার কারণে কারো বাসায় মাংস বা তরকারি আশা করাটাও বোকামি।
সারাদিন ধরে শহরের ভেতর থেকে যুদ্ধের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল এবং শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল আগের দিনের থেকেও ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে। সন্ধ্যার সাথে সাথে আওয়াজ শুনে বোঝা গেল বিদ্রোহীরা যুদ্ধ শেষ করে ফিরে আসছে। সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় অনেক মানুষের “আল্লাহু আকবার” শ্লোগান আমাদের কানে এলো।
আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েই মোত্তালেব গাড়ি না নিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। রাত নয়টার দিকে সে ফিরে এলো। তার কাছে জানা গেল সে বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে গিয়েছিল। রাস্তায় বের হয়ে সে অনুমান করে বিদ্রোহীদের ঘাঁটির দিকে হাঁটতে শুরু করে। পথেই কয়েকজন যোদ্ধা তাকে ঘিরে ফেলে। তখন সে জানায়, সে বিদ্রোহীদের সাপোর্ট করে এবং বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলতে চায়। তখন তারা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে রয়টার্সের সাথেও সাক্ষাৎকার দিয়ে এসেছে।
মাস্তুরার ভাইরা এবং আরো কয়েকজন মোত্তালেবকে ঘুরে ফিরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, বিদ্রোহীরা কারা? আসলেই কি তাদের সাথে তালেবান, ফ্রেঞ্চ এবং কাতারি সৈন্য আছে? মোত্তালেব উত্তর দিলো, তোমরা এখনও এইসব প্রচারণা বিশ্বাস করে বসে আছ? বিদ্রোহীরা প্রায় সবাই-ই মিসরাতি। তবে সিরতের কিছু লোকও তাদের সাথে আছে। আর তাদের ব্যবহার, সেটা আর কী বলব! আমাকে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি, জুস খেতে দিলো, জিজ্ঞেস করল কোন সমস্যা আছে কি না, কোন সাহায্য লাগবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শহরের ভেতরের কোনো খবর আমরা পাচ্ছিলাম না। কামালের বড় ভাই মোহাম্মদ, যে সিরত ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রফেসর, সে শুধু সারা দিন রেডিও শোনার চেষ্টা করছিল। সিরত রেডিও বন্ধ, সেখানে অবিরত রেকর্ড করা গাদ্দাফির পক্ষের গান চলছিল। সন্ধ্যা ছয়টার সময় মিসরাতা রেডিওর সংবাদে বলা হলো, মিসরাতার যোদ্ধারা সিরতের সাবা কিলোর (মাস্তুরার মায়েদের এই এলাকাটাই) পূর্ণ দখল নিয়েছে।
আগের দিন তারা সিরতের পশ্চিমে অবস্থিত জারফ প্রায় বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছিল। তাছাড়া তাদেরই একটা গ্রুপ ভাগ হয়ে সিরতের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে পূর্ব দিকে অবস্থিত গার্দাবিয়া দখল করে নিয়েছে এবং আবুহাদির দিকে এগোচ্ছে। তারা বেনগাজির যোদ্ধাদের সিরতের দিকে আর এগোতে নিষেধ করেছে, তাদের আশা সিরত দখলের জন্য তারাই যথেষ্ট। সিরতের কেন্দ্রে অবস্থিত সাততলা উঁচু একসারি আবাসিক ভবনের (ইমারাত তা’মিনের) উপর ন্যাটোর বিমান হামলার সংবাদও বলা হলো এতে।
রাতের বেলা ন্যাটোর ওড়াউড়ি ছাড়া আর নতুন কিছু ঘটল না। এই প্রথম সিরতের আকাশে ন্যাটো ফাইটার জেটের পাশাপাশি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারও উড়ালো। রাতে অবশ্য ভালো ঘুম হলো না। ছোট একটা ঘরে আমরা বিশ থেকে পঁচিশজন মানুষ ঘুমালাম। ঘরের চারদিকে নিচে বিছানো ম্যাট্রেসে মাথা রেখে পা-গুলো ঘরের কেন্দ্রের দিকে ছড়িয়ে দিলো সবাই। ফলাফল হলো, সবার পা পরস্পরের সাথে ওভারল্যাপ হতে লাগলো।
পরদিন শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সারার পরপরই দেখি আমাদের দুই বাসা পরের আইয়াদ হোয়েদারদের ফ্যামিলিও এখানে এসে হাজির। আইয়াদ বলল, গতকাল সকালে সে ইবনে সিনা হসপিটালে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকতেই তার গাড়ির উপর দিয়ে একটা রকেট উড়ে গিয়ে পেছনের গাড়িকে উড়িয়ে দেয়। ফলে সে ভয় পেয়ে গাড়ি ফেলে গলির ভেতর দিয়ে দৌড়ে বাসার দিকে এগিয়ে যায়।
বাসার কাছাকাছি আসার পর একটা রাস্তার দিকে উঠতে হয়, তাই রাস্তা এড়ানোর জন্য সে কাছাকাছি একটা বাসায় ঢুকে পড়ে পাঁচিল টপকে পার হওয়ার জন্য। সেই বাসায় দুইজন তাওয়ার্গি কৃষ্ণাঙ্গ লিবিয়ান ছিল। আইয়াদ দেখতে পায় একজন মাথায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে, আর অপরজন তাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
দুজন মিলে লাশটাকে একপাশে সরিয়ে দেয়াল টপকে টপকে অবশেষে আইয়াদের বাসায় পৌঁছে। ঘরে পৌঁছানো মাত্রই তারা বিদ্রোহীদের আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনতে পায়। তাকিয়ে দেখে বিদ্রোহীদের পতাকা লাগানো অনেকগুলো গাড়ি সমুদ্রের পাড়ের উঁচু রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আইয়াদ আর তার ছেলে আহমেদ মিলে গুনেছিল সর্বমোট তেষট্টিটা গাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার একই রাস্তা ধরে ফিরে গিয়েছিল।
শনিবারেও দুপুর এগারোটার দিকে যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ঘনঘন গ্র্যাড মিসাইল পড়ার বিকট আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো এবং তার পরপরই বিদ্রোহীরা ফিরে এলো। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য তারা আবার এগুলো।
দুপুর দুইটার দিকে একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটল। আমরা অনেকগুলো গাড়ির আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্রোহীদের ছয়টা অস্ত্রবাহী জীপ এবং পিকআপ কিছু দূরের একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামল এবং কয়েকজন যোদ্ধা সেই বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সেই বাড়িটাতে একটা সুদানি ফ্যামিলি ছিল। তার একটু পরেই তার পাশের বাড়ি থেকে মহিলা এবং বাচ্চাকাচ্চারা চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলো।
পুরো এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ল, বিদ্রোহীরা সুদানি মহিলাকে ধরে নিয়ে গেছে। মহিলাদের মধ্যে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ল। আতেফ এবং আতেফের স্ত্রী মাবরুকা বলতে লাগলো তারা কোনমতেই আর এই এলাকায় থাকবে না। এখানে কোন নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় বিদ্রোহীরা এই বাসায়ও এসে আক্রমণ করতে পারে। এখানে থাকার চেয়ে বাসায় গিয়ে যুদ্ধ করাও বরং আরো ভালো।
দুপুরের খাবারের পর আমরা বসে বসে মিসরাতা থেকে আসা হারাগা আর বুসেফি পরিবারের ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছিলাম। তখন একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। প্রথম প্রথম তারা আমাদের সাথে এমন ভাবে কথা বলছিল, যেন তারা গাদ্দাফির সাপোর্টার। গাদ্দাফি অতুলনীয় নেতা, বিদ্রোহীরা দেশদ্রোহী, ইত্যাদি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝল আমরা গাদ্দাফির বর্তমান নীতির খুব একটা সমর্থক না, বা আমাদের সাথে সত্য কথা বললে নিজেদের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তখন তারা স্বীকার করল তারা মিসরাতা থেকে পালিয়েছে মূলত গাদ্দাফির সৈন্যদের ভয়ে।
সেখানে একটা ছেলের মোবাইল ফোনে একটা ভিডিও দেখলাম যেটা আগে কখনো টিভিতে দেখিনি। ভিডিওটা ত্রিপোলির গ্রিন স্কয়ারের, গোলমালের প্রথম সপ্তাহের, যেদিন গাদ্দাফির ভেনেজুয়েলায় পালানোর গুজব উঠেছিল।
ভিডিওতে দেখা গেল গ্রিন স্কয়ারে এক-দেড়শো মানুষ জড়ো হয়ে গাদ্দাফির বিপক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে, গাদ্দাফির ছবি জ্বালাও-পোড়াও করছে, সাইনবোর্ড ভাংচুর করছে। তাদের বেশিরভাগই খালি হাতে, কয়েকজনের হাতে শুধু লাঠি। এমন সময় দশ-পনেরোটা আর্মির জীপ এবং পিকআপ এলো, পেছনে মেশিনগান ফিট করা। হঠাৎ মেশিনগানের গুলি শুরু হলো। কয়েকজন আন্দোলনকারী মাটিতে পড়ে গেল, আল্লাহু আকবার ধ্বনি শোনা যেতে লাগলো আর বেশিরভাগই পালাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই গাদ্দাফি-সমর্থকরা সবুজ পতাকা হাতে “আল্লাহ্ মোয়াম্মার ওয়া লিবিয়া ওয়া বাস” শ্লোগান দিয়ে গ্রিন স্কয়ারে ঢুকতে লাগলো।
ত্রিপোলির আবু সেলিম তথা বুসলিমেরও ঠিক একই ধরনের আরেকটি ভিডিও দেখা গেল। আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় এত কম ছিল যে, ইচ্ছে করলে সাধারণ পুলিশই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু তা না করে নির্মমভাবে তাদের দমন করা হলো, যেন তারা ভবিষ্যতে আর মিছিল বের করার সাহস না পায়।
শনিবার বিকেলের দিকে গাদ্দাফি সিরিয়া ভিত্তিক আল-রাই টিভিতে অডিও ভাষণ দিলো। ভাষণে গাদ্দাফি বিদ্রোহীদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হওয়ায় রকম এতনিন এবং জাফরানের ভূয়সী প্রশংসা করল। উল্লেখ্য আমাদের বাসাটা জাফরানের একেবারে পূর্বপ্রান্তে তথা রকম এতনিনের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এই এলাকাদুটোর অধিবাসীদের অধিকাংশই হামামলা কবিলার অন্তর্গত এবং এদেরকে বলা হয় হাম্মালি বা বিন হাম্মাল।
গাদ্দাফি তার ভাষণে বিন হাম্মালদেরও প্রশংসা করল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে, পরিচিত এমন কয়েকজনের নামও বলল। ত্রিপোলির পতনের পর সিরতকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল, এবার গাদ্দাফি আশ্বাস দিলো সিরতকে রক্ষা করতে পারলে পরবর্তীতে সিরতকেই স্থায়ীভাবে রাজধানী রাখা হবে।
সন্ধ্যার দিকে মাস্তুরার মায়েদের বাড়িতে মানুষের সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। বু’আরাবিয়াদের ফ্যামিলি এসে জানালো, তাদের ঘরের দোতলায় মিসাইল পড়ে আগুন ধরে গেছে। ঐ অবস্থাতেই তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। তারা জানালো আজ বিদ্রোহীরা সাবা মিয়া নামক এলাকার ভেতরেও ঢুকেছে।
আতেফ আর কামাল অবশ্য এসব কথা বিশ্বাস করতে রাজি না। তাদের দাবি, বিদ্রোহীরা সংখ্যায় কম, মাত্র দশ-বারোটা গাড়ি। তারা এখনও কবরস্থানের সামনেই যেতে পারেনি। যদি তারা সংখ্যায় এত বেশিই হয়, তাহলে পুরো শহর দখল করে ফেলে না কেন?
রাতের বেলা দুপুরের গুজবের সঠিক খবরটা পাওয়া গেল। সকালের দিকে বিদ্রোহীরা যখন প্রচণ্ড মিসাইল আক্রমণের কারণে পিছু হটছিল, তখন তারা এই এলাকার ভেতর থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। তাই তারা সন্দেহজনক কয়েকটা বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করে। তারা কাউকে কিছু না বলে শুধুমাত্র অস্ত্র নিয়েই চলে যায়, কিন্তু পাশের বাসার মহিলারা এতগুলো গাড়ি ভর্তি বিদ্রোহী যোদ্ধা দেখে ভয় পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে এবং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু এই সংবাদ শুনেও আতেফ আর মাবরুকা প্রভাবিত হলো না। তারা এই এলাকাতে থাকবেই না। আতেফের ভাই কামাল এবং মোহাম্মদ অনেক বুঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো সবাই মিলে মাস্তুরার ভাই মোস্তফার শ্বশুর বাড়ি আশরিনে যাবে। আশরিন সিরতের পূর্বদিকে বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম্য এলাকা। ঐদিকটা এখনও গাদ্দাফির দখলে।
গাদ্দাফির পক্ষের লোকদের দাবি, পূর্বদিকে ব্রেগা পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার গাদ্দাফির দখলে। তবে আল-জাজিরা, বিবিসি-সহ সংবাদ মাধ্যমগুলোর আরো দুই সপ্তাহ আগের সংবাদ এবং ভিডিও অনুযায়ী বেনগাজির বিদ্রোহী যোদ্ধারা ওদিকে সত্তর কিলোমিটার দূরে হারাওয়াতে অবস্থান করছে। বিদ্রোহীরা সাধারণত দুপুর এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করে, তাই আমাদেরকে সকাল সকালই যাত্রা শুরু করতে হবে।
রবিবার সকাল আটটার দিকে আমরা সাবা কিলো থেকে আমাদের বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আশরিনে যাব। মেইন রোড দিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় যে দৃশ্য দেখলাম, তার সাথে তুলনা করার মতো দৃশ্য কোনো সিনেমাতেও কখনো দেখিনি।
রাস্তার দুইপাশের প্রত্যেকটা বাড়ি গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা ঝাঁঝরা হয়ে আছে, রকেট আর মর্টারের আঘাতে দেয়ালগুলো ভেঙ্গে চুরে পড়ে আছে। রাস্তায় কিছুদূর পরপর মানুষের গাড়ি পড়ে আছে। গাড়িগুলোর কাঁচ ভাঙ্গা, দরজা খোলা, সামনের রাস্তায় তাজা রক্তের দাগ। রাস্তায় যতদূর চোখ যায়, শুধু বুলেট আর মিসাইলের খোসা। বুলেটের খোসার কারণে গাড়ির চাকা পিছলে পিছলে যাচ্ছে। বিন হাম্মাল মসজিদের মিনারের একটা পাশ ভেঙ্গে আছে।
সবচেয়ে অবাস্তব একটা দৃশ্য হলো, হাইওয়ের এক পাশের লেন দিয়ে আমাদের (মাস্তুরার ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ ওয়াফির) গাড়ি চলছে, আর পাশের লেন দিয়ে বিশালাকৃতির তিনটা উট রাজকীয় ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে আসছে। কারো খামারে ছিল নিশ্চয়ই, গোলাগুলিতে বেরিয়ে পড়েছে।
বাসায় গিয়ে মাত্র জামাকাপড় গোছানো শুরু করেছি, এমন সময় মোহাম্মদ ওয়াফি চিৎকার শুরু করল, তাড়াতাড়ি। ইচ্ছা ছিল সময় পেলে নবী স্যার আর রমজান আংকেলরা কী অবস্থায় আছে সেটা দেখে যাওয়ার, কিন্তু সে সময় আর হলো না। পুনরায় যাত্রা শুরু হলো।
আমাদের বাসা ছেড়ে একটু সামনেই যেই চৌরাস্তার মোড়, সেখানে দেখলাম গাদ্দাফি-বাহিনী চার-পাঁচটা ট্রাক আড়াআড়ি ফেলে রেখে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাকগুলোর আড়ালে সাত-আট জন যোদ্ধা মেশিনগান আর রকেট লঞ্চার নিয়ে রেডি হয়ে আছে। শহরের পশ্চিম দিকে এটাই গাদ্দাফি-বাহিনীর প্রথম বাধা। অর্থাৎ আমাদের বাসাটা এখন আর গাদ্দাফির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নেই, আছে নো ম্যান’স ল্যান্ডে।
শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ন্যাটোর বোমা মারা সাততলা উঁচু ভবনগুলো এবং তার পাশের এমহাম্মেদ ক্যাফেটেরিয়াটা দেখলাম। যেই সাততলা ভবনটার উপর বোমা মেরেছে, সেটার চিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই। পুরো সাততলা একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। চারপাশের রাস্তায় ভাঙ্গা টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আছে। রকম তালাতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শামীম-শাওনদের সাথে দেখা হলো। ওরা তখন পর্যন্ত জানেও না, বিদ্রোহীরা শহরের এত ভিতরে ঢুকে গেছে।
প্রায় আধঘণ্টা চলার পর আমরা আশরিনে এসে পৌঁছলাম। শহরের ভেতরে ততক্ষণে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এ জায়গাটা প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে বলে এখানে শব্দ এসে পৌঁছতে পারছে না।
জায়গাটা পুরাই গ্রামাঞ্চল। বিশাল একটা একতলা বাড়ি, বিশাল তার গেস্টরুম। মহিলারা ভেতরে চলে গেল আর পুরুষদের স্থান হলো বিশাল গেস্টরুমটাতে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই নাস্তা এলো। বেশ ভালো নাস্তা।
তবে আমরা সব মিলিয়ে মোট ত্রিশ জনের মতো এসেছি, শোনা যাচ্ছে আরও আসবে। দোকান-পাট সব বন্ধ, আগে যতটুকু খাবার-দাবার জমাতে পেরেছিল সেটাই এখন ভরসা। কতদিন আমাদের এখানে থাকতে হবে আর কতদিন এরা এত মানুষকে খাওয়াতে পারবে, কে জানে?
১ম পর্ব: ব্যাট্ল ফর সিরত, ২য় পর্ব: বিদ্রোহীদের কবলে, ৩য় পর্ব: গন্তব্য অজানা, ৪র্থ পর্ব: নরকে প্রত্যাবর্তন, ৫ম পর্ব: মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, ৬ষ্ঠ পর্ব: দ্বিতীয় জীবন, ৭ম পর্ব: বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে, ৮ম পর্ব: প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন