তালেবান-আমেরিকার শান্তিচুক্তি নিঃসন্দেহে তালেবানদের জন্য এবং আফগানিস্তানের জন্য বিশাল একটা অর্জন। কিন্তু শান্তির পথ এখনও বহুদূর। শান্তিচুক্তিটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও আরও বৃহত্তর প্রক্ষাপটে এটা খুবই ছোটো একটা স্টেপ।
এই শান্তিচুক্তিকে অনেকেই আমেরিকার জন্য বড় ধরনের পরাজয় হিসেবে দেখছে। এটা একদিক থেকে সত্য। যে তালেবানকে আমেরিকা ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, যাদেরকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে নির্মূল করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, শেষপর্যন্ত তাদের সাথে, তাদের শর্ত অনুযায়ীই শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে – এটা এক ধরনের পরাজয় বৈকি। কিন্তু তালেবান জিতে গেছে, আমেরিকা শেষ হয়ে গেছে বলে যে আবেগী উচ্ছ্বাস সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে, তাতেও একটু সমস্যা আছে।
অন্যায়ভাবে একটা দেশ দখল করে, দুই দশক ধরে হাজার হাজার টন বোমা ফেলে সব কিছু তামা করে দিয়ে, বিনা জবাবদিহিতায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, নিজেদের সিরিয়াস কোনো ক্যাজুয়ালিটি ছাড়াই, ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস ছাড়াই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং নির্বাচনী রাজনৈতিক বিবেচনায় সেনাবাহিনী উইথড্র করলে তাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, তালেবানদের অটুট মনোবলের এবং মাথা না নোয়ানোর নীতির প্রশংসা করা যায়, কিন্তু সেটাকে “আমেরিকাকে হারিয়ে দিয়েছি” বলে উৎসব করাটা ঠিক মানায় না।
কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে যদিও ধরেও নেই, আমেরিকা পরাজিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে, তারপরেও আফগানিস্তানে কী শান্তি আসছে? মনে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নও কিন্তু এক সময় আফগানিস্তানে পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরেও আফগানিস্তানে ইমিডিয়েটলি শান্তি আসেনি। মুজাহেদিনরা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
সেটা নব্বইয়ের দশকের ঘটনা। এখন টেকনোলজি অনেক বেশি উন্নত। টেকনোলজির উন্নতি মানেই সার্ভেইল্যান্সের উন্নতি। এখন ষড়যন্ত্র করার সুযোগও অনেক বেশি।
আমেরিকা চলে যাওয়ার পরেও আফগানিস্তানের পরবর্তী শাসকদের প্রতিটা কর্মকাণ্ডের উপরেই তারা নজরদারি করতে পারবে। নিজেদের পরাজয়ের কালিমাকে চাপা দেওয়ার জন্য তারা যদি আফগানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-গৃহযুদ্ধ জিঁইয়ে রাখতে চায়, নব্বইয়ের দশকের চেয়েও এখন সেটা আরো সহজে করতে পারবে।
আরো পড়ুন: ইরান ক্যাবল: ইরাকে ইরানি গোয়েন্দাদের গোপন কার্যক্রমের তথ্য
আলতাফ পারভেজ ভাই তার প্রথম আলোর কলামে যেমন বলেছিলেন, আমেরিকানরা চলে যাওয়ার পর তালেবানরা কী মডেলে দেশ চালাবে, সেটা এখনও পরিষ্কার না। এটা নতুন একটা পরিস্থিতি। তারা সম্পূর্ণ আগের মডেলেও ফেরত যাবে না, আবার প্রচলিত ইরান বা তুরস্ক মডেলকেও গ্রহণ করবে না। এটা ইউনিক একটা মডেল হবে। এবং এই মডেলে কীভাবে সব দলমতের মানুষকে স্থান দেওয়া হবে, সেটাও একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হবে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা, সেটা হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে আমেরিকা কতটুকু অনেস্ট? আমেরিকা শান্তিচুক্তি করেছে, সে জন্যই সবাই বলছে, আমেরিকা পরাজিত হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে, তালেবান জিতে গেছে। বাস্তবতা পুরোপুরি সেরকমও না। আমেরিকা এখনও এক নম্বর সুপার পাওয়ারই আছে।
এই চুক্তিটা করা হয়েছে প্রধানত ট্রাম্পের উদ্যোগে। নির্বাচনের আগে “বিজনেসম্যান”, “ডিল মেকার” ট্রাম্পের একটা বড় ধরনের শান্তিচুক্তি করে দেখানো দরকার ছিল। আইদার ইরানের সাথে, অর তালেবানের সাথে। ইরানের সাথে হয়নি, তালেবানের সাথে হয়েছে। কিন্তু এটা খুবই সাময়িকও হতে পারে। নির্বাচনের পর এই চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নাও থাকতে পারে। ওবামা ইরাক থেকেও ট্রুপস সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পর আবারও তাদেরকে ফেরত পাঠিয়েছিল।
আমেরিকার চুক্তিভঙ্গের নির্লজ্জ ইতিহাস আছে। ইরানের সাথে ওবামার করা চুক্তি ট্রাম্প এসে বাতিল করে দিয়েছে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যদি বার্নি স্যান্ডার্স না হয়ে অন্য কেউ হয়, সে কি এই চুক্তি মেনে চলবে? তালেবানদের বাইরেও আফগানিস্তানে অন্যান্য যেসব তাকফিরি, খারেজি প্লেয়াররা আছে, বা যেসব বিদেশী এজেন্টরা আছে, যারা এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট হবে, তালেবান যদি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারে, তাহলে তাদের কোনো একটা হঠকারী কর্মকাণ্ডের (নাইন ইলেভেন ভার্সন টু) অজুহাতে আমেরিকা আবারও সেখানে আগ্রাসন চালাতে পারে। অন্তত সময়ে সময়ে গিয়ে বম্বিং করে আসতে পারে।
শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করাটা কঠিন হলেও তুলনামূলকভাবে সহজ, সে তুলনায় শান্তি বজায় রাখাটা অনেক বেশি কঠিন।