আফগান যুদ্ধে আমেরিকা ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু ব্যবসায়ীরা লাভবান

আফগানিস্তানে যে তাসের ঘরের মতো একের পর এলাকার পতন ঘটছে, এরকম ঘটনা কিন্তু একেবারেই নতুন না। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০১৩-১৪ সালে ইরাকেও হুবহু একই ঘটনা ঘটেছিল।

ইরাকেও মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর আইসিস যখন আক্রমণ শুরু করে, তখন ম্যাজিকের মতো একের পর এক শহর তাদের হস্তগত হতে থাকে। লক্ষাধিক সৈন্যের মার্কিন-প্রশিক্ষিত ইরাকি সেনাবাহিনী কয়েকশো আইসিস জঙ্গির হাতে পরাজিত হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমেরিকার দেওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, সাঁজোয়া যান সব আইসিসের হাতে পড়ে। ফলে তারা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

মনে থাকার কথা, সে সময় আইসিসের এই জয় দেখে বাংলার ফেসবুক মুজাহিদগণ দারুণ উল্লসিত হয়েছিল, ঠিক এখনকার মতোই। আইসিসের ব্রুটালিটিকে সমর্থন করার মতো মানুষেরও অভাব ছিল না তখন। এবং আইসিস কীভাবে এত অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এত বড় বাহিনীকে পরাজিত করছে, সেটা নিয়েও তাদের সে সময় কোনো প্রশ্ন ছিল না। তাদের ব্যাখ্যা ছিল – পাবলিক সাপোর্ট এবং হ্যাভেনলি মিরাকল।

পাবলিক সাপোর্টের ব্যাপারে সন্দেহ নাই – এখন যেরকম তালেবানের একের পর এক শহর জয় করার পেছনে পাবলিকের একটা বড় অংশের সাপোর্ট আছে, এতদিন পর্যন্ত সরকারের প্রতি অনুগত লোকাল মিলিশিয়াদের সাইড সুইচ করার ভূমিকা আছে, ইরাকেও ব্যাপারটা সেরকমই ছিল।

কিন্তু বছর না ঘুরতেই যখন দেখা গেল আইসিসের এই ফ্যানাটিসিজমের কারণে দেশে দেশে মুসলমানদেরই বারোটা বাজছে, তখনই শুরু হলো কন্সপিরেসি থিওরি – আইসিসকে নিশ্চয়ই আমেরিকা আর ইসরায়েলই সাহায্য করেছিল, নাহলে এটা হলো কীভাবে, ওটা হলো কীভাবে?

আইসিস এবং তালেবান ভিন্ন সংগঠন। তাদের আদর্শে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ইনফ্যাক্ট আফগানিস্তানে আইসিস এবং তালেবান একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। সো তালেবানকে আইসিসের সাথে তুলনা করছি না। বাট তারপরেও ইরাকে ২০‌১৩-২০১৪ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল, আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে ঠিক সেরকম ঘটনাই ঘটছে। এবং তখনকার মতোই এখনও বাংলার ফেসবুক মুজাহেদিনদের মধ্যে ব্যাপক উল্লাস দেখা যাচ্ছে।

যদিও আমি মনে করি না তালেবান আইসিসের মতো ফ্যানাটিক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, বাট তারপরেও যদি তালেবানের উল্টাপাল্টা কোনো পদক্ষেপের কারণে ভবিষ্যতে পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশের মুসলমানদের উপর বিপর্যয় নেমে আসে, নিশ্চিত থাকতে পারেন তখনও আবার কন্সপিরেসি থিওরি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু অন্ধভক্তের মতো বিশ্বাস বা কন্সপিরেসি থিওরি প্রচারের বাইরে এসব ঘটনার মাঝামাঝি একটা ব্যাখ্যা আছে, যেটা মোস্ট লাইকলি বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা।

ইরাক বা আফগানিস্তানে আমেরিকা যে শতশত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে আমেরিকার অপচয় এবং সেই সূত্রে তাদের পরাজয়, বাস্তবে ব্যাপারটা পুরোপুরি সেরকম না। হ্যাঁ, আফগান যুদ্ধে ২০ বছরে আমেরিকার বিশাল ব্যয় হয়েছে, এবং এর ফলে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার বিশাল ক্ষতি হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত যেহেতু তালেবান পরাজিত হয়নি, তাই নিঃসন্দেহে আমেরিকারই পরাজয় ঘটেছে।

বাট সিরিয়াসলি, আপনি কেন বিশ্বাস করেন আমেরিকার ক্ষমতাসীনরা আফগানিস্তানে তালেবানকে বা ইরাকে সাদ্দামের বাথ পার্টিকে পুরোপুরি পরাজিত করতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বা রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকাকে লাভবান করতে যুদ্ধ শুরু করেছিল?
আপনার দেশে রাজনীতিবিদরা যখন কোনো ক্রিটিকাল ডিসিশান নেয়, কোনো দেশের সাথে বড় কোনো ধরনের সামরিক চুক্তি করে, আপনার কি মনে হয়, তারা দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে, নাকি অন দ্য ওয়ে তার নিজের এবং ব্যবসায়ী আত্মীয়-স্বজনের পকেটে কত টাকা আসবে, সেই চিন্তা করে? তাহলে আমেরিকার ব্যাপারটা ভিন্ন হবে কেন?

আমেরিকা এত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে – এটা রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার বিশাল ক্ষতি। কিন্তু যারা যুদ্ধ শুরু করেছে, যাদের প্ররোচনায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাদের ক্ষতি না, বরং তাদের লাভ। কারণ এই টাকাগুলোর একটা বড় অংশ গেছে বিভিন্ন আমেরিকান সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর এবং এনজিওর পকেটে।

কোনো একটা সাক্ষাৎকারে নোম চমস্কিই বলেছিল – আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল ওয়ার অন টেররের জন্যও না, উইপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশনের জন্যও না। তারা যুদ্ধ করেছিল টু স্টিল হিউজ অ্যামাউন্ট অফ পাবলিক মানি। এবং সেটা যেহেতু তারা সফলভাবে করতে পেরেছে, নিজেদের খুব কম মৃত্যু এবং হতাহতের বিনিময়ে, তাই এই যুদ্ধে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা পরাজিত হলেও ক্ষমতাসীন আমেরিকানরা লাভবানই হয়েছে।

এখন যেখানে আমেরিকার মূল লক্ষই ছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে সেগুলোর বড় একটা অংশ পকেটস্থ করা, কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে, তারা দখলকৃত দেশে যেই পাপেট সরকারকে ক্ষমতায় বসাবে, তারা হবে চরম দুর্নীতিবাজ। সেটা ইরাকের ক্ষেত্রেও সত্য, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও সত্য।

একইসাথে যেহেতু এই প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরদের কন্ট্রাক্ট নির্ভরই করে সেসব দেশের অস্থিতিশীলতার উপর, তাই ইরাকে বাথ পার্টির বা একিউআইর ইনসার্জেন্টদেরকে বা আফগানিস্তানে তালেবানকে পুরোপুরি নির্মূল করে ফেলাটাই আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে। তারা সব সময়ই চাইবে – আমরা যতদিন থাকব, ততদিন এই ইনসার্জেন্টরা দুর্বল থাকুক, মাঝে মাঝে আক্রমণ করুক, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে না যাক। এবং সেটাই ঘটেছে।

তো এরকম পরিস্থিতিতে আমেরিকা যখন চলে যাবে, তখন কী ঘটবে? তাদের পাপেট সরকার যেহেতু চরম দুর্নীতিবাজ, ব্যর্থ এবং অজনপ্রিয়, তাই এমনিতেই জনগণ থাকবে তাদের বিরুদ্ধে। তার উপর দখলদার শক্তির সহযোগী হওয়ার কারণে তাদের মোরালিটিও থাকবে তলানিতে। বিপরীতে তাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছিল, এমনিতেই দখলদার শক্তি চলে যাওয়ায় তাদের মোরালিটি থাকবে হাই গ্রাউন্ডে, পাবলিক সাপোর্ট থাকবে তাদের পক্ষে, এবং তারা লড়াই করবে বুভুক্ষুর মতো। ফলে জয়টা তাদেরই হওয়ার কথা – দুই দিন আগে আর পরে।

এবং সেটাই ঘটেছে ইরাকে, এখন ঘটছে আফগানিস্তানে। খুব বেশি পার্থক্য নাই। পার্থক্য হবে ভবিষ্যতে। ইরাকে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল – আইসিস, তারা ছিল খারেজাইটস, ফ্যানাটিকস। তাদের ব্রুটালিটির বিরুদ্ধে পুরা দুনিয়া এক হয়েছিল, আমেরিকা আবার ফিরে এসেছিল। এমনকি ইরান এবং আমেরিকা একসাথে কাজ করেছিল।

তালেবান অতীতেও আইসিসের মতো ব্রুটালিটি দেখায়নি, এবারেও দেখাবে সেই সম্ভাবনা কম। কিন্তু তারপরেও তারা কতটুকু আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে, সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে কাবুল পর্যন্ত যাওয়ার পর তাদের শাসনব্যবস্থা কীরকম হবে, তার উপর। ২০০১ সালের আগেও তালেবান সো কলড “ইসলামিক ইমারাত” প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান, সৌদি আর আমিরাত ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশ তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি। এবার কে কে দিবে, সেটা দেখার বিষয়।

যুদ্ধ করে শহর জয় করা বা বিপ্লব করে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ। এরপরের স্টেজগুলোই কঠিন। সেখানেই আমেরিকা দেশে দেশে ব্যর্থ হয়েছে। আরব বসন্তে সো কলড মডারেট ইসলামিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। তালেবান কতটুকু পারবে, সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত না। রেগুলার সিকিউরিটি ফোর্স গঠন করা, নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই কঠিন, তার উপর আঞ্চলিক সংঘাত, বিদেশী ষড়যন্ত্র থাকবে না, এমন মনে করার কোনো কারণ নাই।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *