আবু উবাইদা: এই মুহূর্তে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সেলিব্রেটি

সুপারহিরোরা সাধারণত নিজেদের চেহারা প্রকাশ করতে পছন্দ করে না। তারা সাধারণত মুখোশের আড়ালে থেকেই মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পছন্দ করে। আজকে আমি ঠিক এরকম একজন সুপারহিরোর কথাই আপনাদের সামনে তুলে ধরব, যার নাম আবু উবাইদা। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, তিনি কোনো কমিকস বইয়ের সুপারহিরো না। তিনি হচ্ছেন একেবারে বাস্তবের একজন সুপারহিরো। একজন ফিলিস্তিনি সুপারহিরো।

গত দুই মাস ধরে এই সুপারহিরো হয়ে উঠেছেন ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের প্রতীক। আরব ন্যাশনাল হিরো। কিন্তু আমাদের আজকের গল্পের যে প্রধান ভিলেন- ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, শিন বেত অথবা আমান, তারা কেউই এখন পর্যন্ত এই সুপারহিরো সম্পর্কে বিন্দুমাত্র তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। এই সুপারহিরো হচ্ছেন – আবু উবাইদা। ফিলিস্তিনের হামাসের কাসসাম ব্রিগেডের মিলিটারি স্পোকসম্যান।

আবু উবাইদা কে?

আবু উবাইদার নাম লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করলে আপনি অনেক ধরনের তথ্য পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই। এগুলোর অধিকাংশই মূলত ইসরাইলি প্রপাগান্ডা।

আবু উবাইদার মূল পরিচয় তার আশেপাশের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি তার নামটা যে আবু ওবায়দা, এটাও কিন্তু তার আসল নাম না। এটা হচ্ছে ছদ্মনাম, যেটাকে বলা হয় কুনিয়া অথবা Nom De Guerre।

এই নামটা তিনি কেন গ্রহণ করেছেন সেটা যদিও তিনি কখনো স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু অনুমান করা যায়, যেহেতু আবু উবায়দা ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহাবী – আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ। তিনি ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারাদের মধ্যে একজন। অর্থাৎ যে ১০ জন সাহাবী জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন।


এই আর্টিকেলটা মূলত আমার একটা ইউটিউব ভিডিওর অনুলিখন। ভিডিওটা ইউটিউব রিমুভ করে দিয়েছে। কিন্তু আপনি চাইলে ভিডিওটা দেখতে পারবেন আমার টেলিগ্রাম চ্যানেলের এখান থেকে। ভালো লাগলে আমার ইউটিউব চ্যানেলটা সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারেন।


তবে ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে এই সাহাবী আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ ছিলেন হযরত উমর রাঃ এর আমলে যে খুলাফায়ে রাশেদীন আর্মি জেরুজালেম সীজ করেছিল, বা জেরুজালেম জয় করেছিল, সেই বাহিনীর কমান্ডার।

সুতরাং ফিলিস্তিনের একজন কমান্ডার, বর্তমান যুগের এবং হামাসের একজন মুখপাত্র, তিনি যে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ’র নাম অনুসারে নিজের ছদ্মনাম গ্রহণ করবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক।

ইন্টারনেটে আবু উবায়দা সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে যে তার গ্রামের বাড়ি ফিলিস্তিনের নিলিয়া নামক গ্রামে। এবং তিনি গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন। এমনকি সেই মাস্টার্সের থিসিসের যে শিরোনাম, সেটাও ইন্টারনেটের পাওয়া যায়। বলা হয় যে সেটা হচ্ছে The Holy Land between Christianity, Judaism and Islam।

কিন্তু যেটা বলেছি যে এই তথ্যগুলোর অধিকাংশই ইসরায়েলি প্রপাগান্ডা। ইসরাইল এমনকি এটাও দাবি করেছে যে তারা এই আবু উবাইদার মুখোশের পেছনে যে লোকটা, তার পরিচয়টা বের করতে পেরেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন স্পোকসম্যান, Avichay Adraee দাবি করেছেন যে এই আবু উবাইদার পেছনে যেই লোকটা, তার নাম হচ্ছে হুজাইফা সামির আবদুল্লাহ আল কাহালুত।

কিন্তু যেটা বলেছি যে এর কোন ভিত্তি নেই। হামাস এটা অস্বীকার করেছে এবং এখন পর্যন্ত বাস্তবে আবু উবায়দার পরিচয় জানা যায়নি। যদি জানা যেত তাহলে ইসরায়েল এতদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখত না। তাকে হত্যা করার চেষ্টা করত।

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

আমার নতুন বই!!!

স্পাই স্টোরিজ ২: স্নায়ুযুদ্ধের সফলতম ডাবল এজেন্টের কাহিনি

অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে ননফিকশন স্পাই থ্রিলার। উচ্চপদস্থ এক ডাবল এজেন্টের কাছে ১৫ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনি।

৪০০ .০০

বইমেলায় থাকছে ৪৩৯ নম্বর (সতীর্থ প্রকাশনার) স্টলে। এছাড়াও পাবেন রকমারি ডট কমে (৩৫% ছাড়ে), প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ (৩৫% ছাড়ে) এবং আপনার পছন্দের যেকোনো অনলাইন বুকশপে।

বিস্তারিত
Short PDF

আবু উবাইদার উত্থানের পেছনের করুণ কাহিনি

আবু উবাইদার উত্থানের পেছনে খুবই করুন এবং খুবই ইন্টারেস্টিং একটা কাহিনী আছে। প্রথমত, 2002 সাল থেকে কিন্তু আবু উবাইদাকে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে। যদিও তখনও তিনি মুখপাত্র ছিলেন না এবং তখনও তিনি ক্যামেরার সামনে কোন ঘোষণা নিয়ে আসেননি, কিন্তু বিভিন্ন ভিডিওতে তাকে এরকম মুখোশ পরা অবস্থায় দেখা গেছে। তখনও তাকে কেউ চিনত না, কিন্তু পরবর্তীতে তাকে চিহ্নিত করা গেছে যে ইনিই হচ্ছেন আবু উবাইদা।

2005 সালে ইসরাইল যখন গাজা থেকে তাদের সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়, তখন হামাস তাদের যে মিলিটারি উইং – কাসসাম ব্রিগেড, সেই কাসসাম ব্রিগেডের সামরিক মুখপাত্র হিসেবে আবু উবাইদাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ করে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তিনি বড় ধরনের কোনো ঘোষণা দিয়ে ক্যামেরার সামনে আসেননি।

আবু উবায়দা ক্যামেরার সামনে আসেন মূলত 2006 সালে, খুবই করুণ একটা ঘটনার পর। 2006 সালের জুন মাসের 9 তারিখে ফিলিস্তিনি একটা পরিবার – আবু গালিয়া পরিবার, তারা বেইত লাহিয়ার বীচে গিয়েছিল সময় কাটাতে। সেখানে ইসরাইলি গানশিপ থেকে গুলি করে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

পুরো পরিবার মারা যায়। শুধুমাত্র ছোট একটা মেয়ে- হুদা, সে বেঁচে থাকে। সেটা একটা ভিডিওতে ধরা পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায় যে বাচ্চা মেয়েটা একবার তার মায়ের কাছে ছুটে যাচ্ছে, একবার বাবার কাছে ছুটে যাচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদছে, ইয়াবা ইয়াবা বলে ডাকছে তার বাবাকে- খুবই করুন একটা ভিডিও।

ভিডিওটা ফিলিস্তিনদের মনে খুবই গভীরভাবে রেখাপাত করে। ফিলিস্তিনের যে জাতীয় কবি মাহমুদ দারউইশ, তিনি তখন সেই মেয়েটাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন।

ঘটনাটা ঘটেছিল 2006 সালের জুনের 9 তারিখে। এবং এর মাত্র কয়েকদিন পরেই, জুনের 25 তারিখে হামাস একটা অপারেশন পরিচালনা করে, গাজার দক্ষিণে রাফাহ বর্ডার ক্রসিং এর কাছাকাছি জায়গায়। অপারেশন টার নাম ছিল Shattered Illusion। সেই অপারেশনে তারা দুজন ইসরাইলের সৈন্যকে হত্যা করে এবং একজন ইসরাইলি সৈন্যকে, অর্থাৎ গিলাদ শালিককে তারা অপহরণ করে।

এটা ছিল বেশ বড় একটা অপারেশন, বেশ সফল একটা অপারেশন। এবং এই অপারেশনের ঘোষণা দেওয়ার জন্যই আবু ওবায়দা প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন। এবং এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলা যায় যে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন এবং সমগ্র আরব বিশ্বে তিনি জনপ্রিয় এবং পরিচিত একটা নাম হয়ে ওঠেন।

2006 সালের ঐ ঘটনার পর থেকে গত 17 বছর ধরে হামাস ততগুলো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করেছে, যতগুলো নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে, রকেট নিক্ষেপ করেছে, সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরেই আবু ওবায়দা সেগুলোর ঘোষণা দিয়েছেন এবং মিডিয়ার সামনে এসেছেন। কিন্তু এবারের মতো জনপ্রিয়তা তিনি কখনোই অর্জন করতে পারেননি।

এবার তার ঘোষণাগুলো, তার বক্তব্যগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ দেখছে। আরব বিশ্বের প্রতিটা মানুষ প্রতিদিন অপেক্ষা করে এই আবু উবাইদার বক্তব্যের জন্য, তার ঘোষণা শোনার জন্য- আজকে তিনি কী বলছেন, যুদ্ধের অগ্রগতি কতটুকু?

এই আর্টিকেলটা যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমার এই বইটাও আপনার ভালো লাগতে পারে:

গল্পগুলো সিরিয়ার: বুলেট, রক্ত, রাজনীতি এবং বিপন্ন মানবতা

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হচ্ছে এই সময়ের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রধান শিকার, সিরিয়ার সাধারণ জনগণ সম্পর্কে তেমন কিছুই আমরা জানি না।

আমরা জানি না কীভাবে তারা অবরোধ, দুর্ভিক্ষ আর বিমান হামলার মধ্য দিয়ে একটা একটা করে দিন অতিবাহিত করেছে, কীভাবে অপহৃত আত্মীয়-স্বজনদের বেঁচে ফেরার আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনেছে, কীভাবে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেছে, কীভাবে নতুন জীবনের আশায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।

“গল্পগুলো সিরিয়ার” বইটি সেই হৃদয় বিদারক অজানা কাহিনীগুলোই তুলে এনেছে পাঠকদের সামনে।

বিস্তারিত
Short PDF

আবু উবাইদার ভাষণের বৈশিষ্ট্য

আবু ওবায়দার বক্তব্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি বক্তব্যের শুরুতে শুধুমাত্র মুসলমানদেরকে না বা ফিলিস্তিনদের কে না, তিনি সম্বোধন করেন সমগ্র বিশ্বের স্বাধীন মানুষদেরকে। ইয়া আহরার আল-আলাম- এভাবে সম্বোধন করেন। অর্থাৎ সারা বিশ্বের স্বাধীন মানুষজন।

তিনি বক্তব্য শেষ করেন খুবই বিখ্যাত একটা বাক্য দিয়ে। সেটা হচ্ছে- ইন্নাহু লাজিহাদ, নাসরুন আও ইসতিশহাদ। এর অর্থ হচ্ছে- এটা হচ্ছে জিহাদ এবং এর ফলাফল হচ্ছে, হয় বিজয় অথবা শাহাদাত বরণ।

এটা হচ্ছে ফিলিস্তিনের একজন বিপ্লবী নেতা, শেখ আইজউদ্দিন আল-কাসসামের একটা উক্তি। এই শেখ আইজুদ্দিন আল-কাসসামের নাম অনুসারেই আসলে কাসসাম ব্রিগেডের নামটা গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন প্রধান নেতা। এবং ব্রিটিশরা যখন তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে, তখন তিনি আত্মসমর্পণ না করে এই ঘোষণাটা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে শহীদ হন।

যেটা আগেই বলেছি – আবু ওবায়দা এখন পর্যন্ত তার চেহারা জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। তিনি সবসময়ই একটা লাল রঙের কেফিয়া দিয়ে তার মুখ ঢেকে রাখেন, শুধুমাত্র চোখের জায়গাটুকু খোলা থাকে। তার কপালের উপর সব সময় একটা হেডব্যান্ড পরা থাকে, সেখানে দুটো লাইন লেখা থাকে।

উপরের লাইনটা হচ্ছে কালিমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ। মাঝখানে একটা লোগো, লোগোটা হচ্ছে কাসসাম ব্রিগেডের লোগো। আর দ্বিতীয় যে লাইনটা, সেটা হচ্ছে- কাতাএব আল-কাসসাম, অর্থাৎকাসসাম ব্রিগেড।

তার হাতের বাহুতে একটা পতাকা থাকে। পতাকাটা হচ্ছে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা। আর তার বুকে একটা লেখা থাকে, সেটা হচ্ছে- আন-নাতেক আল-আসকারি, অর্থাৎ মিলিটারি স্পোকসম্যান।

এটা হচ্ছে খুবই সাধারণ, খুবই সাদামাটা একটা পোশাক। এবং এই পোশাক পরেই আবু উবাইদা যখন বক্তব্য দেন, ভাষণ দেন, তখন সেটা সমগ্র আরব বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তার ভাষণ শোনার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে।

ইমেইলের মাধ্যমে নতুন পোস্টের আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে 30 জনের সাথে যোগ দিন।

আবু উবাইদার জনপ্রিয়তার রহস্য

গত কয়েক মাসে আবু ওবায়দা যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন সেটা এক কথায় অবিশ্বাস্য। আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে।

আমরা একটা ছোট একটা মেয়ের ভিডিও আমরা দেখতে পেয়েছি যেখানে মেয়েটা একটা ওয়ার্কারকে কাজ করতে দেখছে, সেই ওয়ার্কারটা লাল রঙের একটা কেফিয়া পরে ছিল, এবং তাকে দেখিয়ে সেই ছোট শিশু সে বলছে – ওবায়দা, ওবায়দা! অর্থাৎ সে মনে করছে যে সেই লোকটা হচ্ছে আবু উবাইদা।

আমরা এক বৃদ্ধের ভিডিও দেখেছি, ইসরায়েল যখন সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিল, তখন সেই বৃদ্ধ পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সৈন্যদেরকে বলছিল যে আবু উবাইদা তোমাদেরকে ডিসিপ্লিনড করেছে, তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে।

আমরা জর্ডানের মানুষদেরকে আবু ওবায়দার নামে স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করতে দেখেছি। কারণ আবু উবাইদা এর আগের দিন তার ভিডিওতে জর্ডানের মানুষদেরকে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন যে তোমার রাস্তায় নেমে আসো, তোমরা আরো বেশি আন্দোলন করো। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরের দিন লক্ষ লক্ষ জর্ডানিয়ান নাগরিক রাস্তায় নেমে এসেছিল এবং তারা আবু উবাইদার নামে স্লোগান দিচ্ছিল।

আবু ওবায়দার অকল্পনীয় জনপ্রিয়তার মাত্রাটা আমরা বুঝতে পারি যখন আমরা দেখতে পাই যে ইন্টারনেটের তার নামে বিভিন্ন ধরনের মিম, বিভিন্ন ধরনের কৌতুক, বিভিন্ন ধরনের পপ রেফারেন্স ছড়িয়ে পড়ছে।

এটা হচ্ছে বর্তমান সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য যে যখন কোনো ব্যক্তি বা কোন বিষয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, মানুষের হৃদয়কে অনেক বেশি নাড়া দিতে পারে, তখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা তার নামে বিভিন্ন কৌতুক তৈরি করে, বিভিন্ন মিম তৈরি করে। এবং এটা আমরা আবু ওবায়দার ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি।

এবং এক্ষেত্রে আমাদের যে প্রশ্নটা আমাদের মাথায় আসে, সেটা হচ্ছে আবু উবাইদার এত জনপ্রিয়তার আসলে রহস্য কী? কারণ আবু উবাইদা তো আসলে কোনো মিলিটারি লিডার না, অথবা পলিটিক্যাল লিডারও না। আবু ওবায়দা কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না, তিনি কোন ধরনের যুদ্ধ করেন না।

তিনি জাস্ট হামাসের অবস্থানটা বর্ণনা করেন, ব্যাখ্যা করেন, বা ঘোষণা দেন। তিনি প্রতিদিনের যুদ্ধের অগ্রগতি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু তারপরও মানুষ আবু উবাইদাকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা করে, মানুষ আবু ওবায়দাকে নিয়ে যে পরিমাণ আগ্রহ দেখায়, যেভাবে তার নামে স্লোগান দেয়, এটা খুবই মানে আশ্চর্যজনক একটা ব্যাপার।

আবু ওবায়দা কেন এত জনপ্রিয় সে বিষয়ে আমি কয়েকটা পয়েন্ট বলতে পারি।

প্রথমত, আমরা যদি অন্যান্য আরব নেতাদের বক্তব্যগুলো দেখি, গাদ্দাফি থেকে শুরু করে, জামাল আব্দুল নাসের থেকে শুরু করে, বর্তমান সময়ের যেকোনো নেতা- তাদের বক্তব্যগুলো হয় অনেক লেংদি বক্তব্য। একেকজন নেতা এক ঘন্টার নিচে কেউ বক্তব্য দেয় না।

আমরা সম্প্রতি হেজবুল্লাহর প্রধান যে হাসান নাসরুল্লাহ, তার বক্তব্য দেখেছি, সেটাও প্রায় এক ঘন্টার বেশি। এটা হচ্ছে আরব নেতাদের একটা বৈশিষ্ট্য যে তারা খুব লেংদি বক্তব্য দিতে পছন্দ করে। এবং লেংদি বক্তব্য দিলে যেটা হয়, তাদের বক্তব্য অনেক সময় বোরিং হয়ে ওঠে, বিরক্তিকর হয়ে ওঠে এবং অপ্রয়োজনীয় অনেক কথাবার্তা চলে আসে। সে জায়গায় আবু উবায়দার বক্তব্যগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত এবং টু দ্য পয়েন্ট।

আমার সবগুলো বই


মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ ২ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার গল্পগুলো সিরিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদ

দ্বিতীয়ত, আবু উবাইদার বক্তব্যের শব্দগুলো খুবই ওয়েল চোজেন হয়। তার বক্তব্যগুলো তো আরবিতে, আমাদের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না, কিন্তু বক্তব্যগুলোর রেফারেন্স এরকম থাকে এবং বক্তব্যগুলোর ভাষা, শব্দচয়ন এরকম থাকে যে মানুষ সেগুলোর সাথে সরাসরি নিজেকে কানেক্ট করতে পারে।

যেমন একটু আগে যেটা বলেছিলাম যে তার বক্তব্যে তিনি সবসময় শুধুমাত্র ফিলিস্তিনদেরকে সম্বোধন করেন না। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে এবং সমগ্র বিশ্বের মানুষদেরকে সম্বোধন করেন। তিনি বলেন – ইয়া আহরার আল-আলাম, অর্থাৎ বিশ্বের স্বাধীন জনগণ। এভাবে তার আরবি শব্দগুলো এমনভাবে তিনি বাছাই করেন, যেগুলো মানুষকে সরাসরি আলোড়িত করে।

তৃতীয়ত, আবু ওবায়দার বক্তব্যগুলো খুবই অথেন্টিক, সেগুলোর মধ্যে কোন বাগাড়ম্বর নেই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুদ্ধের সময় আমরা যেটা দেখি যে যুদ্ধে প্রতিটা পক্ষই অনেক বেশি প্রপাগান্ডা চালায়। যুদ্ধের একটা অস্ত্রই হচ্ছে প্রপাগান্ডা। এটা আমরা শুধুমাত্র পশ্চিমা মিডিয়ার বা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে না, আরব রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও এটা আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়।

ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের যে তথ্যমন্ত্রী ছিলেন – সাইদ আল-সাহাফ, অনেকের মনে থাকার কথা তার কথা। তিনি যখন বক্তব্য দিতেন, সেই বক্তব্যগুলো আসলে কোনো অর্থ ক্যারি করত না। কারণ সেই বক্তব্যে প্রপাগান্ডার মাত্রা থাকত অনেক বেশি। ইরাক যখন প্রায় হেরে যাচ্ছিল, তখনও তিনি দাবি করছিলেন যে আমরা অনেক এগিয়ে আছি। আমরা ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে পারছি শত্রু পক্ষের উপর। কিন্তু বাস্তবতার সাথে সেগুলোর কোন মিল ছিল না

লিবিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি – আমি লিবিয়াতে আছি এবং 2011 সালেও ছিলাম – সেখানে লিবিয়ায় গাদ্দাফির যে মুখপাত্র ছিলেন মুসা ইব্রাহীম, তার বক্তব্যও একই ধরনের ছিল। বিদ্রোহীরা যে একের পর এক বিভিন্ন শহর দখল করে নিচ্ছিল, সেটা তিনি স্বীকারই করতেন না, পুরোপুরি উড়িয়ে দিতেন। তিনি দাবি করতেন গাদ্দাফির হাতেই 95% লিবিয়া।

তো এই ধরনের বক্তব্য যখন মানুষ দেখতে পায় যে বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল নেই, তখন একটা অংশের মানুষ আশা করে বসে থাকলেও বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে সেই বক্তব্যের এবং সেই বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।

কিন্তু আবু উবাইদার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তিনি যতগুলো বক্তব্য দিচ্ছেন সেগুলো একেবারে টু দ্য পয়েন্ট এবং অথেন্টিক। ফলে মানুষের মধ্যে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। এবং যেখানে ইসরাইলি প্রপাগান্ডা অনেক বেশি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে, শুধুমাত্র ইসরাইলি না, পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা অনেক বেশি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হচ্ছে, সেখানে আবু ওবায়দাই হয়ে উঠেছেন এই যুদ্ধের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সোর্স।

তো আমার মনে হয় এই সবগুলো কারণ একত্রে মিলিয়েই, অর্থাৎ আবু উবাইদার বক্তব্যের মধ্যে যে স্ট্রং ডিটারমিনেশন এবং তার বক্তব্যের অথেন্টিসিটি – এগুলো সবগুলো মিলিয়েই আসলে আবু উবায়দার জনপ্রিয়তাকে এরকম সীমানা ছাড়িয়ে দিতে পেরেছে। আবু ওবায়দা হয়ে উঠেছে ঘরে ঘরের একটা জনপ্রিয় নাম। এবং বলা যায় এই মুহূর্তে আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। যদি এই বছরের ম্যান অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত করতে হয়, আমার মনে হয় আবু ওবাইদা তার প্রধান একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া উচিত।

আমার বিশ্লেষণমূলক লেখা যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে আমার এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন:

উপসংহার

আবু উবাইদার এই মুখোশের আড়ালে আসলে কে আছে, তার ব্যক্তি পরিচয়টা কি, অনেকেই এটা জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু আমার মনে হয় যে এটা আমাদের জন্য জানা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। এবং এটা আসলে আমাদের জানার দরকারও নেই। আবু উবাইদা যে একটা ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে এবং প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে, এটাই আসলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *