পলিটিক্যাল থ্রিলার মুভিগুলো আমার দারুণ পছন্দের। আর সেটা যদি সত্য কাহিনী অবলম্বনে হয়, তা হলে তো কথাই নেই। অল দ্যা প্রেসিডেন্টস মেন (All The President’s Men) সেরকমই একটা মুভি, যার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ওয়াটারগেট ক্যালেঙ্কারির তদন্তকে ঘিরে।
দুই দুঃসাহসী সাংবাদিক কী অসাধারণ দক্ষতা এবং সাহসিকতার সাথে ওয়াটারগেট ক্যালেঙ্কারির পেছনের ঘটনা উন্মোচন করে শেষপর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে, সেই কাহিনীর সফল চিত্রায়ন এই মুভিটি। বলা যায় এই ক্যাটাগরির এটাই সেরা মুভি।
১৯৭২ সালের ১৭ই জুন ডেমোক্র্যাটদের হেডকোয়ার্টার, ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে আড়িপাতা যন্ত্র স্থাপন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় পাঁচ ব্যক্তি। বিষয়টির উপর রিপোর্ট করতে গিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক তরুণ সাংবাদিক বব ঊডওয়ার্ড (রবার্ট রেডফোর্ড) জানতে পারে, পাঁচজনের সবাই কোনো না কোনোভাবে সিআইএর সাথে জড়িত। একজনের সাথে আবার তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টারও সম্পর্ক আছে।
শুরু হয় ববের তদন্ত। নিজের আগ্রহে অনেকটা জোর করেই তার সাথে এসে যোগ দেয় আরেক তরুণ সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টাইন (ডাস্টিন হফম্যান)। তাদের অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার পেছনের ঘটনা – কীভাবে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠজনেরা দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন অসৎ উপায়ে রিপাবলিকানদেরকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা পাকাপাকি করে।
কিন্তু তদন্ত করা খুব একটা সহজ হয় না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ধামাচাপা দেওয়া হতে থাকে, রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট, সাক্ষীরাও কেউ মুখ খুলতে রাজি হয় না। বাধ্য হয়ে বব যোগাযোগ করে তার পুরানো গোপন সূত্র “ডীপ থ্রোট” এর সাথে।
কিন্তু এটা একেবারেই উচ্চ পর্যায়ের স্পর্শকাতর ঘটনা হওয়ায় ডীপ থ্রোটও পরিষ্কার করে কিছু বলতে চায় না। তবে সে বিভিন্ন হেঁয়ালির মাধ্যমে এগোনোর পথ বাতলে দেয়। অন্য সব পত্রিকা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ চুপ থাকায় এবং জোরালো কোনো সাক্ষী-প্রমাণ না থাকায় সম্পাদকও প্রথমে আর্টিকেলগুলো ছাপাতে রাজি হয় না। কিন্তু বব এবং কার্ল অভিনব বুদ্ধিতে সাক্ষীদের মুখ থেকে কথা বের করে আনতে থাকে। শেষপর্যন্ত সম্পাদকও তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়। শুরু হয় একের পর আর্টিকেল প্রকাশ, যার ফল হিসেবে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আমার সবগুলো লেখা একত্রে পেতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে।
শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাপ্রবাহ এবং অ্যালান জে পাকুলার অসাধারণ পরিচালনার কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র রবার্ট রেডফোর্ড আর ডাস্টিন হফম্যানের দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণেই মুভিটা দেখা আবশ্যক। বিশেষ করে রবার্ট রেডফোর্ডের অভিনয় তো দুর্দান্ত!
একটা দৃশ্য আছে যেখানে রেডফোর্ড একটা সিঙ্গেল টেকে একটানা ছয় মিনিট দুই ব্যক্তির সাথে ফোনে কথা বলতে থাকে এবং একেবারে শেষে এসে সে একজনের পরিবর্তে ভুলে অন্যজনকে সম্বোধন করে ফেলে। সম্ভবত এই ভুলটা স্ক্রিপ্টে ছিল না, সত্যি সত্যিই ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু রেডফোর্ড একটুও অপ্রতিভ না হয়ে একেবারে বাস্তবসম্মতভাবেই অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকে এবং পরিচালকও সেটা না কেটে মুভিতে রেখে দেয়।
এছাড়া আরেকটা জায়গায় এক স্প্যানিশ ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার সময় রেডফোর্ড ঘুরে তাকিয়ে সহকর্মীদেরকে জিজ্ঞেস করতে চায়, তাদের কেউ স্প্যানিশ জানে কি না। কিন্তু ভুলে সে বলে ফেলে “Do any of you guys speak English?” পরে একটু বোকা হাসি হেসে আবার কথাটা রিপিট করে বলে, “Do any of you guys speak Spanish?” এখানের এই ভুলটাও না কেটে মুভিতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
এরকম অসংখ্য ছোট ছোট জিনিস এই মুভিটাকে নিখুঁত, বাস্তবসম্মত একটা মুভি হিসেবে সার্থকতা দিয়েছে। যেমন অফিসে এবং ঊডওয়ার্ডের ঘরে অগোছালো পত্রিকা এবং কাগজপত্রের স্তূপ জমে থাকা, ফোনে কথা বলতে বলতে ঊডওয়ার্ডের নোটপ্যাডে মানুষের চেহারা আঁকিবুঁকি করতে থাকা, অহঙ্কারী সম্পাদকের টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে সম্পাদনা করা এবং বার্নস্টাইনের দিকে গরম চোখে ঘুরে তাকানো – এ সবই পরিচালকের পারফেকশনের উদাহরণ।
তবে সম্পাদক বেন ব্র্যাডলির চরিত্রে অভিনয় করা জেসন রবার্ডসের কৃতিত্বও অস্বীকার করার করার উপায় নেই। তার সিরিয়াস অভিনয় দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই এটা অভিনয় নাকি সত্যি। পরিচালক এই সিনেমার খুঁটিনাটির প্রতি কত বেশি মনোযোগ দিয়েছেন সেটা বুঝার জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট। সেটা হচ্ছে সেই সময়ের ওয়াশিংটন পোস্ট অফিসে যে কোম্পানির ডেস্ক ব্যবহার করা হতো, ফিল্মে দেখানোর জন্য সেই একই কোম্পানি থেকে প্রায় ২০০টা ডেস্ক কেনা হয়েছিল। প্রতিটা ডেস্কের দাম প্রায় ৫০০ ডলার।
এই মুভিটাতে ওয়াশিংটন পোস্টের যে সেট ব্যবহার করা হয়েছে, সেটার আকার-আকৃতি এবং আসবাবপত্রের সাজ-সজ্জা হুবহু সত্যিকারের পোস্টের অফিসের মতো। আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে, মুভি শুরু হওয়ার সময় টাইপ রাইটারে টাইপ করার যে দৃশ্যটা দেখানো হয়, তখন পেছনে যে সাউন্ড ব্যবহার করা হয়, সেটা আসলে টাইপরাইটারের শব্দ না, গুলির শব্দ! সাংবাদিকের টাইপরাইটারের শক্তি যে কোনো অংশে অস্ত্রের শক্তি অপেক্ষা কম না, সেটা বোঝানোর জন্যই এ আয়োজন!
১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিটির IMDB রেটিং 8.0। পলিটিক্যাল কারণেই পলিটিক্যাল মুভিগুলোর রেটিং একটু কম হয়ে থাকে। তা না হলে এটা নিঃসন্দেহে টপ লিস্টে বেশ উপরের দিকে স্থান পেত। সেরা পার্শ্ব অভিনেতা এবং সেরা চিত্রনাট্যসহ মোট চারটি অস্কার জয়ী এই ফিল্মটির অবস্থান আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় ৭৭ নম্বরে।
একটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি, সেটা হচ্ছে এই ফিল্মটা এতোই নিখুঁত যে, বিশ্বের অনেক জায়গায় সাংবাদিকতার ছাত্রদেরকে এই ফিল্মটা দেখানো হয়!