হুইসেল ব্লোয়ারদের কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে এডওয়ার্ড স্নোডেন কিংবা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কথা, কিংবা বড়জোর পেন্টাগন পেপার্সের ড্যানিয়েল এলসবার্গের কথা। সন্দেহ নেই, তাদের প্রত্যেকের কাজই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তারা মার্কিন সরকারের টপ সিক্রেট তথ্যগুলো প্রকাশ করেছেন বা করতে পেরেছেন সময়ের অনেক পরে।
সেই তুলনায় ক্যাথারিন গান এক ব্যতিক্রমী হুইসেল ব্লোয়ার। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যখন জানতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য মিলে অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণের জন্য জাতিসংঘের ভোট জালিয়তি করতে যাচ্ছে, তখন তিনি সময়ের অনেক আগেই সেটা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সময় থাকতেই অন্যায় একটা যুদ্ধ থামিয়ে দিতে। বলাই বাহুল্য, তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু সন্দেহ নেই তিনি বিশ্বের সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।
ক্যাথারিন গান ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা GCHQ-এর একজন ট্রান্সলেটর। ২০০৩ সালে তিনি দেখতে পান, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসএর একজন কর্মকর্তা জিসিএইচকিউকে অনুরোধ করছে, ইরাক আক্রমণের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে ভোটের আয়োজন করা হবে, তাতে পাঁচ অস্থায়ী সদস্যের ভোট যেন যুদ্ধের পক্ষে আনা যায়, সেজন্য তাদের প্রতিনিধিদের উপর নজরদারি করে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার মতো তথ্য-প্রমাণ খুঁজে বের করতে।
ক্যাথারিন আগে থেকেই লক্ষ্য করছিলেন, কীভাবে সাদ্দামের পারমাণবিক অস্ত্র, আল-কায়েদা কানেকশন নিয়ে বুশ-ব্লেয়ার একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় এই সিক্রেট মেমো দেখার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই অন্যায় যুদ্ধ থামানোর জন্য তাকে যদি জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়, তিনি সেটাই নিবেন। তিনি মেমোটার প্রিন্ট-আউট নিয়ে তার এক অ্যান্টি-ওয়ার মুভমেন্টের বান্ধবীর কাছে হস্তান্তর করে দেন সাংবাদিকদেরকে দেওয়ার জন্য।
আপনি যদি এসপিওনাজ জগত সম্পর্কে আগ্রহী হন, তাহলে আমার লেখা স্পাই স্টোরিজ (রকমারি লিঙ্ক এখানে) এবং স্পাই স্টোরিজ ২ (রকমারি লিঙ্ক এখানে) বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন। বই দুটোতে উঠে এসেছে এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি।
সে সময় ব্রিটিশ পত্রিকা অবজার্ভারের নীতিগত অবস্থান ছিল যুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু এটা ছিল পত্রিকার প্রকাশক/সম্পাদকের অবস্থান। বাস্তবে অনেক সাংবাদিকই ছিল যুদ্ধের বিপক্ষে। তাদেরই একজন ছিলেন মার্টিন ব্রাইট। তার এবং তার এক সহকর্মীর চাপে শেষপর্যন্ত অবজার্ভার এই নিউজটা প্রকাশ করে। তারা শিরোনাম করে, “Revealed: US dirty tricks to win vote on Iraq war”। পুরো মেমোটাই তারা তুলে দেয় ফ্রন্টপেজে।
ক্যাথারিনের নাম তখনও কেউ জানত না। তিনি হিরো হওয়ার জন্য গোপন তথ্য লিক করেননি। তিনি চেয়েছিলেন একটা অন্যায় যুদ্ধকে থামাতে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে তাই তিনি শুধু মেমোটাই লিক করেছিলেন। কিন্তু জিসিএইচকিউ যখন তাদের প্রতিটা কর্মচারীকে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, লাই ডিটেক্টরে বসাতে শুরু করে, তখন তিনি সামনে এগিয়ে আসেন এবং নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন।
ক্যাথারিন গানের জীবনী নিয়ে একটা বই আছে, যার শিরোনাম The Spy Who Tried to Stop a War: Katharine Gun and the Secret Plot to Sanction the Iraq Invasion। এই বই অবলম্বনেই এ বছর মুক্তি পেয়েছে মার্কিন-ব্রিটিশ চলচ্চিত্র Official Secrets (2019)। পরিচালনা করেছেন রেন্ডিশন এবং আই ইন দ্য স্পাইয়ের পরিচালক গ্যাভিন হুড।
এতে ক্যাথারিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী কিরা নাইটলি। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন র্যালফ ফিনেস। ডকুড্রামা জঁনরার চলচ্চিত্রটিতে ক্যাথারিনের পাশাপাশি অবজার্ভারের মার্টিন ব্রাইটের চরিত্রটিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।
এ বছর দেখার মতো অনেকগুলো সিরিয়াল বের হলেও ভালো চলচ্চিত্রের সংখ্যা এখন পর্যন্ত হাতে গোণা। এই মুভিটাকে এখন পর্যন্ত বছরের সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটা হিসেবেই দাবি করব। আইএমডিবি রেটিং 7.3, রটেন টমাটোজ রেটিং 84%, পার্সোনাল রেটিং 8। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও এই মুভি মাস্ট ওয়াচ। ইরাক যুদ্ধের নোংরা দিকগুলো নিয়ে সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। সেদিক থেকে এটা ব্যতিক্রমী সিনেমা।
সিনেমার শ্যূটিংয়ের আগে অভিনেত্রী কিরা নাইটলি গিয়েছিলেন আসল ক্যাথারিন গানের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি যে নিজের দেশের আইন ভঙ্গ করেছেন, এতো বছর পর এখন আপনার মনোভাব কী? ক্যাথারিন উত্তর দিযেছেন, আমার যেটা করা উচিত ছিল, সেটাই করেছি। আমাকে যদি আবারও এই কাজ করতে হয়, তাহলে আবারও করব।
এসপিওনাজ সংক্রান্ত আমার সবগুলো লেখার তালিকা একসাথে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।
very nice write up
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।