আসাদ-মাখলুফ দ্বন্দ্বের পটভূমি

লিবিয়ার পরিস্থিতি খারাপ বলে ওদিকে সিরিয়াতে যে বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটনা ঘটেছে, সেদিকে নজরই দেওয়া হয়নি। সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদের সাথে রামি মাখলুফের সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সরকার রামি মাখলুফের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে এবং তার ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে সিরিয়া শাসন করছিল দুইটা পরিবার – আসাদ পরিবার এবং মাখলুফ পরিবার। হাফেজ আল-আসাদের স্ত্রীর নাম ছিল আনিসা মাখলুফ। মাখলুফরা হচ্ছে তারই আত্মীয়-স্বজনরা। সিরিয়ার প্রায় সব ব্যবসা-বাণিজ্য এই দুই পরিবারের হাতে। এবং বলতে গেলে বেশিরভাগই মাখলুফদের হাতে। কারণ হাফেজ উঠে এসেছিল দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে, কিন্তু আনিসা ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী।

ধারণা করা হয় যুদ্ধের আগে রামি মাখলুফ একাই সিরিয়ার ৬০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। সিরিয়াতে তার ডাক নাম ছিল “মিস্টার টেন পার্সেন্ট”, যেহেতু তাকে বিভিন্ন ব্যবসার ১০% ভাগ দিতে হতো। তার আরেকটা নাম ছিল “রামি আল-হারামি” তথা রামি দ্য থিফ।

সিরিয়ার সরকারি টেলিকম কোম্পানি সিরিয়াটেল, যেটা ছিল সিরিয়ার মাত্র দুইটা টেলিকম কোম্পানির একটা, সেটাও ছিল রামি মাখলুফের। এবং বিদ্রোহের প্রথম সপ্তাহেই আন্দোলনকারীরা সিরিয়াটেলের হেডকোয়ার্টারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

গৃহযুদ্ধ শুরুর পর স্বাভাবিকভাবেই রামি মাখলুফ বাশারের পক্ষে অবস্থান নেয়, বাশারের সেনাবাহিনীকে এবং মিলিশিয়াগুলোকে ফান্ডিং করে। এবং এসব ফান্ডিংয়ের সব টাকা পুরোপুরি “বৈধ” ব্যবসা থেকেও আসেনি।

জার্মান পত্রিকা ডের স্পিগেলের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী হেজবুল্লাহ সিরিয়াতে আসার পরপরই তাদের একটা গ্রুপ রামি মাখলুফের সহায়তায় সিরিয়ার ড্রাগ (ক্যাপ্টাগন) প্রোডাকশনের দুইটা ল্যাবের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবং তারা কৃষকদেরকে গাঁজার উৎপাদন বাড়ানোরও নির্দেশ দেয়। এতে সাহায্য করে বাশারের ভাই মাহের, যার অধীনস্থ ব্রিগেডগুলোর উপর ইরানের প্রভাব ব্যাপক।

এই ব্রিগেডগুলো এবং হেজবুল্লাহর কিছু ইউনিট মিলে সিরিয়াতে ক্যাপ্টাগন এবং হাশিশ উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখাশোনা করত এবং এরপর সেগুলো রামি মাখলুফের বৈধ ব্যবসার আড়ালে করে রপ্তানি হতো মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এরকম বেশ কয়েকটা চালান ধরা পড়ে যায়। একটা ধরা পড়ে মিসরে (সম্ভবত লিবিয়ায় আসার সময়), আরেকটা ধরা পড়ে দুবাইয়ে, আরেকটা সৌদি আরবে।

মিসরের পোর্ট সাঈদে যে চালানটা ধরা পড়ে, সেখানে হাশিশগুলো লুকানো ছিল দুধের প্যাকেটের ভেতর। মোট চার টন হাশিশ লুকানো ছিল ১৯,০০০ দুধের প্যাকেটের ভেতর। এবং যেই দুধের কোম্পানিটাকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেটা ছিল রামি মাখলুফের মালিকানাধীন।

মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশে এতগুলো চালান ধরা পড়া যাওয়াটা সন্দেহজনক। ভেতর থেকে কেউ কি তবে পোর্ট অথরিটিদেরকে খবর দিয়ে দিচ্ছে? আটক করার ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিচ্ছে? সেরকম হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু কে করছে কাজটা? আসাদ পরিবার?

আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আমার সবগুলো লেখা একত্রে পাবেন এই লিঙ্কে

আসাদ-মাখলুফের মধ্যকার সম্পর্কের এই ফাটলের ব্যাপারে একাধিক থিওরি আছে। একটা হচ্ছে, এর পেছনের মূল কারিগর বাশারের স্ত্রী আসমা আসাদ। ধারণা করা হয় আসমা মাখলুফ পরিবারের বিজনেস মনোপলিতে ভাগ বসাতে চায়। আসমা নিজে মাখলুফ পরিবারের না, সে ভিন্ন একটা সুন্নি পরিবার আখরাসের সদস্য।

ইতোমধ্যেই রামি মাখলুফের একটা দাতব্য সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আসমার একটা দাতব্য সংস্থা। এবং এরকম রিপোর্টও আছে, রামি মাখলুফের বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগ যে, সে সিরিয়াটেলের কয়েকশো মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স বাকি ফেলে রেখেছে, সেটা আসলে কভার। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সিরিয়াটেলকে বাজেয়াপ্ত করে বা অধিগ্রহণ করে সেটাকে নতুন একটা কোম্পানির সাথে মার্জ করে দেওয়া, যার নাম হবে এমাটেল (আসমার ডাকনাম এমা), এবং যার মালিক আসমা আসাদ।

অ্যানিওয়ে এটা হচ্ছে একটা ব্যাখ্যা। আরেকটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, পুরো বিষয়টার পেছনে আছে রাশিয়া। সিরিয় যুদ্ধের মূল জটিলতাগুলো শেষ – কাজেই এখন রাশিয়া চায় সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। আর এক্ষেত্রে তাদের প্রধান বাধা ইরান এবং ইরান-ব্যাকড মিলিশিয়ারা। সিরিয়াতে ব্যবসার দিক থেকেও ইরান হচ্ছে রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার ইরানের অবস্থানকে ইসরায়েলও নিজের জন্য হুমকি মনে করে।

সিরিয়াতে ইসরায়েল এ পর্যন্ত যতগুলো হামলা করেছে, তার প্রায় সবগুলোই করেছে ইরান-ব্যাকড মিলিশিয়াদের উপর। শুধুমাত্র বাশারের বাহিনীর উপর করেনি, রাশিয়ার উপর করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অর্থাৎ ইরান যদি চলে যায়, তাহলে ইসরায়েলও আপাতত সিরিয়াতে নাক‌ গলাবে না।

অন্তত রাশিয়া সেরকমই বিশ্বাস করে। সেজন্যই সাম্প্রতিক সময়ে ইরান-ব্যাকড মিলিশিয়া ঘাঁটিতে ইসরায়েলের আক্রমণের সময় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া-ব্যাকড সিরিয়ান ডিফেন্স সিস্টেম থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।

সুতরাং এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যেটা ডের স্পিগেলও কনফার্মও করছে, রাশিয়া চাচ্ছে সিরিয়া থেকে ইরানকে সরিয়ে দিতে। এবং এটার একটা উপায় হচ্ছে সিরিয়াতে ইরানের ব্যবসার উপর আক্রমণ করা। এবং এ কারণে সম্ভবত রাশিযার ইশারাতেই হেজবুল্লাহ এবং মাহ‌ের-রামির ড্রাগ চালানগুলো বিভিন্ন পোর্টে আটক হয়েছে। সিরিয়ার ভেতরেও বাশার ড্রাগ ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।

পুরো ব্যাপারটার মধ্যে সবচেয়ে মজার অংশটা ছিল যখন সিরিয়ান ইন্টেলিজেন্স রামি মাখলুফের ব্যবসার উপর আঘাত হানার পর সে পরপর কয়েকবার লাইভে এসে জনগণের সামনে বাশারের কাছে এর বিচার দেয় যে, বাশারের বাহিনী তার উপর জুলুম করছে!

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *