খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তায় – সৌদি আরব বলেছে, তারা চীনের কাছে তাদের তেলের একটা অংশ ইউএস ডলারে তথা পেট্রোডলার-এ বিক্রি না করে বরং চাইনিজ মুদ্রা ইউয়ানে বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে।
নিউজটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কারণ একদিকে কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে, অন্য দিকে চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে। ওদিকে চীন আবার আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সৌদি আরব যদি আসলেই এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয় – পেট্রোডলার থেকে বেরিয়ে এসে পেট্রোইউয়ানের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ডলারের ভবিষ্যতটা কী হবে? এটাই কি হবে ইউএস ডলারের ‘দ্য বিগিনিং অফ দ্য এন্ড’? এর মাধ্যমেই কি পেট্রোডলার এবং সেই সাথে বিশ্বের উপর মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটবে?
নাকি এটা জাস্ট সৌদি আরবের একটা ব্লাফ? আমেরিকার উপর চাপ সৃষ্টি করার একটা প্রচেষ্টা? যদি সেটাই হয়ে থাকে, তাহলে এর মধ্য দিয়ে সৌদি আরব আসলে কী অর্জন করতে চাইছে?
এই ব্যাপারগুলো নিয়েই আজকের আর্টিকেল। তবে স্বাভাবিকভাবেই এটা শুধুমাত্র অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা হবে না। এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসবে ইতিহাস এবং রাজনীতি – পেট্রোডলারের ইতিহাস, সৌদি-আমেরিকা সম্পর্ক, সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।
বিস্তারিত দেখুন ইউটিউব ভিডিওতে:
প্রথমেই একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে নেওয়া দরকার যে, এখনও কিন্তু কিছুই হয়নি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জাস্ট একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে, সৌদি আরব চীনের কাছে যে পরিমাণ তেল বিক্রি করে, তার একটা অংশ ইউয়ানে বিক্রি করার চিন্তাভাবনা করছে।
লক্ষ করুন, এখনও কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি, ফাইনাল কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এবং যদি হয়ও তারপরেও কিন্তু এরকম না যে তারা ডলারকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে পুরোপুরি ইউয়ানে তেল বিক্রি করা শুরু করবে। বলা হয়েছে যে, তারা কেবল একটা অংশ ইউয়ানে বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে।
কাজেই কেউ যদি ভেবে থাকেন যে, আগামী কয়েক মাস বা কয়েক বছরের মধ্যেই ডলারের আধিপত্য শেষ হয়ে যাবে, ইউয়ানের আধিপত্য শুরু হবে, তাহলে সেটা ভুল হবে। কিন্তু যদি আসলেই সৌদি আরব এরকম পদক্ষেপ নেয়, এবং তাদের দেখাদেখি অন্যান্য দেশও এগিয়ে আসে, তাহলে? হ্যাঁ, তাহলে কয়েক বছরে তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও কয়েক দশকের মধ্যে ডলারের আধিপত্য, এবং সেই সাথে মার্কিন আধিপত্য শেষ হওয়ার বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে – কেন? ডলার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আর সৌদি আরবের ভূমিকাই বা এখানে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা ডলার বাদে অন্য কোনো মুদ্রায় লেনদেন শুরু করলে পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে?
সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে পেট্রোডলারের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। কারণ বর্তমানে বিশ্বের উপর আমেরিকার যে একচ্ছত্র আধিপত্য, তার অন্যতম প্রধান কারণ এই পেট্রোডলার, এবং তার পেছনে অন্যতম প্রধান অবদান এই সৌদি আরবের।
পেট্রোডলার জিনিসটা চালু হয়েছে সত্তরের দশকে। কিন্তু পেট্রোডলার বোঝার আগে আমাদেরকে আরেকটা জিনিস বুঝতে হবে – সেটা হচ্ছে ব্রেটন-উডস অ্যাগ্রিমেন্ট।
ব্রেটন উডস অ্যাগ্রিমেন্ট কী?
একটা সময় বিশ্বের প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রের মুদ্রা ছিল গোল্ড ব্যাকড। অর্থাৎ কোন দেশের মুদ্রার মান কত, সেটা নির্ভর করত সেই দেশের কাছে কী পরিমাণ স্বর্ণ মজুত আছে, তার উপর।
সিস্টেমটা ভালোই চলছিল, কিন্তু সমস্যা হয় পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়। সে সময় অস্ত্র এবং রসদ কেনার জন্য সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা আমেরিকার কাছ থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে এত বেশি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম কেনে, যে যুদ্ধের শেষের দিকে দেখা যায় সমগ্র বিশ্বের ৭০ ভাগ স্বর্ণ চলে গেছে আমেরিকার কাছে।
স্বর্ণের মজুদ কমে যাওয়ায় ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন সবাই বুঝতে পারে, আমেরিকার কাছেই সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুদ এবং যুদ্ধের পর আমেরিকাই হবে বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি, তখন মিত্রশক্তির ৪৪টা দেশ মিলে সিদ্ধান্ত নেয় – তারা সবাই এখন থেকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরিত্যাগ করবে এবং মার্কিন ডলারকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গ্রহণ করবে।
১৯৪৪ সালে আমেরিকার নিউহ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন-উডসে এই চুক্তি সম্পাদিত হয় বলে এটি ব্রেটন-উডস অ্যাগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত।
নিক্সন শক কী?
ব্রেটন-উডস চুক্তির ফলে ডলার হয়ে ওঠে বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ কারেন্সি। বিশ্বের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক লেনদেন হতে থাকে ডলারে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, যখন আমেরিকা ভিয়েতনাম, কোরিয়া-সহ একের পর এক বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
যুদ্ধে আমেরিকা এত বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে শুরু করে, অনেক দেশ ডলারের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আমেরিকার ফেডেরাল রিজার্ভ থেকে ডলার উঠিয়ে নিতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়, আমেরিকা শেষ পর্যন্ত স্বর্ণের সাথে মার্কিন ডলারের যে সম্পর্ক ছিল, সেটার অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়, যেন তারা ভল্টে থাকা স্বর্ণের চেয়েও বেশি পরিমাণে ডলার ছাপিয়ে সংকট সামাল দিতে পারে।
১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই ঘোষণা দিয়ে সবাইকে চমকে দেন বলে এটাকে বলা হয় নিক্সন শক। সে সময় বলা হয়েছিল এই পদক্ষেপ অস্থায়ী। কিন্তু সেই অস্থায়ী পদক্ষেপ আজও বহাল আছে।
পেট্রোডলারের ইতিহাস
স্বর্ণের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার পরেও অবশ্য পরিস্থিতির বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। তার উপর ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ তথা ইওম-কিপুর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের নেতৃত্বে তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার উপর তেল অবরোধ দেয়, তখন আমেরিকার পথে বসার মতো উপক্রম হয়।
সে সময় আমেরিকাকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে শুরু করেন। এবং তিনি সৌদি আরবকে এমনভাবে কনভিন্স করতে সক্ষম হন যে, তেল অবরোধ দেওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তেমন কোনো অর্জন ছাড়াই সৌদি আরব অবরোধের অবসান ঘটায়। সেই সাথে তারা আরেকটা কাজ করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে তারা শুধু আমেরিকা না, যেকোনো দেশের কাছে তেল বিক্রির বিনিময়ে কেবলমাত্র ডলার ব্যবহার করবে। এটাকেই বলা হয় পেট্রোডলার।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, সৌদি আরবের এই পদক্ষেপের বিনিময়ে আমেরিকা তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সম্ভাব্য যেকোনো যুদ্ধ, বিপ্লব, অভ্যুত্থান থেকে আমেরিকা সৌদি রাজপরিবারকে রক্ষা করবে। তাদেরকে সামরিক সহায়তা দিবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের হয়ে যুদ্ধ করবে। এবং যেটা তারা আসলেই করেছিল, ১৯৯০ সালে, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়।
অ্যানিওয়ে, কিসিঞ্জার শুধু সৌদি আরব না, অন্যান্য উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রকেও কনভিন্স করতে সক্ষম হন। এবং তাদের দেখাদেখি ওপেকভুক্ত সবগুলো রাষ্ট্রই ডলারে তেল বিক্রি করতে শুরু করে। যেহেতু তেলই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এনার্জি রিসোর্স, তাই তেল উৎপাদনকারী সবগুলো রাষ্ট্র যখন ডলারে কেনাবেচা শুরু করে, তখন ডলারই হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং একক রিজার্ভ কারেন্সি।
বিশ্বের প্রায় সবগুলো রাষ্ট্র ডলারে কেনাবেচা শুরু করে, ডলারে বন্ড কেনে, এবং ফরেন রিজার্ভ হিসেবে ডলার সঞ্চয় করে রাখতে শুরু করে। অর্থাৎ সবাই ডলারের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে এবং ডলারের স্থিতিশীলতার উপর বিশ্বাস করতে শুরু করে। সেই সাথে বিশ্ব অর্থনীতির সেরা ব্রেইনরাও যেহেতু আমেরিকার জন্য কাজ করে, তাই তাদের শ্রম এবং মেধা আমেরিকার ফাইন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোকে আরও সুদৃঢ় করে। ডলার হয়ে ওঠে সেকেন্ড গড।
পেট্রোডলারের সমস্যা
সমস্যা হয়, বিশ্বের সবার একচেটিয়াভাবে ডলারের এই নির্ভরশীলতাকে আমেরিকা উইপনাইজ করতে শুরু করে। তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর অবরোধ দিতে শুরু করে। যেমন ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে এবং সম্প্রতি বাইডেন প্রশাসন রাশিয়াকে সুইফট সিস্টেম থেকে বহিষ্কার করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আমেরিকা নিজের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন দেশের ফরেন রিজার্ভ ফ্রিজ করে দিয়েছে।
তো এসব কারণে সাম্প্রতি বছরগুলোতে অনেক রাষ্ট্রই ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে। অনেকে কিছু কিছু লেনদেনের ক্ষেত্রে ইউরো ব্যবহার করছে, এবং অতি সম্প্রতি চীন তাদের মুদ্রা ইউয়ানকেও তেল বেচাকেনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তালিকাভুক্ত করেছে।
সৌদি আরব কেন ইউয়ান ব্যবহার করতে চায়?
এখন কথা হচ্ছে, চীন যেহেতু সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে চাইছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে ডলারের পরিবর্তে নিজেদের মুদ্রা ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু এখানে সৌদি আরবের স্বার্থটা কোথায়? সৌদি আরব তো আমেরিকার পরীক্ষিত মিত্র। তারা কেন আমেরিকার স্বার্থ বাদ দিয়ে চীনের স্বার্থ দেখবে?
এর উত্তরটা নিহিত আছে সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিশ্ব-রাজনীতিতে।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সৌদি আরবের সাথে আমেরিকাের সম্পর্ক এখন আর আগের মতো ভালো না। আমেরিকা নিজেই এখন বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। আগে তারা সৌদি আরব থেকে দিনে ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ক্রয় করত। এখন সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৫ লাখ ব্যারেলে। কাজেই তেলের জন্য আমেরিকা আর আগের মতো সৌদি আরবের উপর নির্ভরশীল না, এবং এরফলে তারা সৌদি আরবকে আগের মতো সামরিক সাহায্য দেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা মনে করে না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের ইয়েমেন যুদ্ধে একটা সময় আমেরিকা সাহায্য দিলেও এখন সেই সাহায্য অনেক কমিয়ে এনেছে এবং এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তাদের উপর চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের প্রধান শত্রু ইরানের সাথে বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি নতুন করে নিউক্লিয়ার ডিল করতে চাইছে – যে ডিল সফল হলে ইরানের উপর থেকে বিভিন্ন অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হতে পারে, এবং এরফলে ইরান আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এর কোনোটাই সৌদি আরবের পছন্দ না।
এছাড়াও সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যাকান্ড নিয়ে আমেরিকাতে সৌদি যুবরাজ প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। সৌদি আরব চাইছিল মার্কিন প্রশাসন এসব মামলা থেকে যুবরাজকে দায়মুক্তি দেক। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেটা তো করেইনি, উল্টো ২০২০ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন বলেছিলেন, খাশোগজি হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি আরবকে একঘরে করে দেওয়া উচিত।
এসব কারণে সৌদি আরব আমেরিকার উপর তথা বাইডেন প্রশাসনের উপর অসন্তুষ্ট। তাদের এই অসন্তোষের সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি, যখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে সৌদি আরবকে ফোন করা হয়েছিল প্রিন্স মোহাম্মদকে রিকোয়েস্ট করার জন্য, তিনি যেন বাইডেনের সাথে ফোনে কথা বলেন। কথা বলা তো দূরের কথা, সৌদি আরব হোয়াইট হাউজের সেই ফোন কল রিসিভই করেনি।
বিপরীতে গত কয়েক বছর ধরেই চীনের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে। চীন সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-তে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। এছাড়াও তারা সৌদি আরবকে তাদের নিজস্ব ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্মাণে সহযোগিতা করেছে। এমনকি তারা সৌদি আরবের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম চালুর ব্যাপারেও আলোচনা শুরু করেছে।
সোজ কথায় বলতে গেলে, চীন সৌদি আরবকে ঠিক সেসব জিনিস দিচ্ছে, যেগুলো আমেরিকা তাদেরকে দিচ্ছে না। এবং চীন তাদেরকে সেগুলো দিচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী অধিকার – এসব বিষয়ে কোনো লেকচার না দিয়েই।ফলে স্বাভাবিকভাবেই চীনের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে।
এই সুযোগেই চীন যখন চাইছে সৌদি আরব তাদের কাছে ডলারে না বিক্রি করে ইউয়ানে তেল বিক্রি করুক, তখন সৌদি আরব সেটাকে একেবারে ফেলে না দিয়ে বিবেচনা করে দেখছে।
চীন এই মুহূর্তে সৌদি আরবের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। সৌদি আরবের প্রায় ২৫% তেলই তারা ক্রয় করে, যার পরিমাণ দিতে প্রায় পৌনে ২ মিলিয়ন ব্যারেল। কাজেই সৌদি আরব যদি এর একটা অংশ ইউয়ানে বিক্রি করতে শুরু করে, তাহলে সেটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হবে।
সৌদি আরব কি পেট্রোডলার বর্জনে সফল হবে?
এখন কথা হচ্ছে, সৌদি আরব কি আসলেই সেটা করবে? কয়েক বছর আগে হলেও বলা যেত, সম্ভবতা না। এটা সম্ভবত একটা ব্লাফ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার উপর আমেরিকা এবং ইউরোপ যেভাবে অবরোধ দিয়েছে, এবং সৌদি আরবের সাথেও আমেরিকার সম্পর্ক যেরকম খারাপ যাচ্ছে, তাতে সৌদি আরব যদি নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু পরিমাণ ফরেন রিজার্ভ ডলারে না রেখে ইউয়ানে রাখতে চায়, তাহলে সেটা বেশ বাস্তবসম্মত পদক্ষেপই হবে।
কিন্তু চাইলেও সৌদি আরবের পক্ষে রাতারাতি সব তেল ডলার বাদ দিয়ে ইউয়ানে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। কারণ সৌদি রিয়াল এখনও ডলারের সাথে লিঙ্কড। এবং সৌদি আরবের বিশাল ফরেন রিজার্ভ এখনও ডলারে সঞ্চিত। রাতারাতি কিছু করতে গেলে ডলারের উপর যদি বিরূপ প্রভাব পড়ে, তাতে আমেরিকা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলা মুশকিল, সৌদি আরব নিজেই পথে বসার উপক্রম হবে।
তাছাড়া চীনের মুদ্রা ইউয়ানের কনভার্টিবিলিটি এখনও অনেক কম। এর উপর চীনের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও অনেক বেশি।
কাজেই সৌদি আরব যেটা বলেছে, তারা আপাতত একটা অংশ ইউয়ানে বিক্রি করা শুরু করতে পারে। এরপর তাদের দেখাদেখি অন্যান্য রাষ্ট্রও যদি এগিয়ে আসে, এবং ধীরে ধীরে চীনও যদি তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায়, তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে ডলারের একটা শক্তিশালী বিকল্প তৈরি হওয়া মোটেও অসম্ভব কিছু না।
এটা এখনই ঘটবে না। অন্তত পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে না। বিশ-ত্রিশ বছরেও যদি একটা বিকল্প তৈরি হয়ে যায়, এবং এরপর কোনো দিন আমেরিকান অর্থনীতি ক্র্যাশ করে, সেদিন ইউয়ানই হয়তো বা হয়ে উঠতে পারে নতুন দিনের ডলার।
সৌদি আরব বিষয়ক সকল লেখা পড়ুন এখান থেকে।