![১৯৬৯ সালে অভ্যত্থানের পর প্রথম ভাষণে গাদ্দাফি](https://mhtoha.com/wp-content/plugins/phastpress/phast.php/c2VydmljZT1pbWFnZXMmc3JjPWh0dHBzJTNBJTJGJTJGbWh0b2hhLmNvbSUyRndwLWNvbnRlbnQlMkZ1cGxvYWRzJTJGMjAyMCUyRjA5JTJGR2FkZGFmaS0xOTY5LUNvdXAuanBnJmNhY2hlTWFya2VyPTE3MTQwNzk0OTYtNDM1NDImdG9rZW49MjViOTUyMjI0YjdlYmY4Yw.q.jpg)
১৯৬৯ সালের এই দিনে (১লা সেপ্টেম্বর) মাত্র ২৭ বছর বয়সী এক যুবক লিবিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। সেই যুবক, ক্যাপ্টেন মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফির শাসনামল স্থায়ী হয় পরবর্তী ৪২ বছর পর্যন্ত।
টেকনিক্যালি গাদ্দাফি নিজে সেদিন ফিল্ডে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি আগে থেকে সবকিছুর আয়োজন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু অভ্যুত্থানের দিন তিনি বাকি সবাইকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিতে চলে গিয়েছিলেন। সকালবেলা তিনি যখন ঘুম থেকে ওঠেন, ততক্ষণে অভ্যুত্থান ঘটে গেছে।
অভ্যুত্থানে কেউ কোনো বাধা দেয়নি। জামাল আব্দুল নাসেরের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত গাদ্দাফির অনুগত অফিসাররা যখন সরকারি ভবনগুলোতে প্রবেশ করে, সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে তাদেরকে স্বাগত জানায়। সম্পূর্ণ বিনা রক্তপাতে পতন ঘটে পশ্চিমাপন্থী অথর্ব বৃদ্ধ রাজা ইদ্রিস আল-সেনুসীর। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এরকম শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থান খুব কমই আছে।
সে সময় গাদ্দাফিকে তেমন কেউ চিনত না। সিআইএ জানত লিবিয়াতে ক্যু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারা ইদ্রিসকে এ ব্যাপারে সতর্কও করেছিল। মোসাদও সিআইএকে দিয়ে ইদ্রিসকে সতর্ক করিয়েছিল। মূলত ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইদ্রিসের নিষ্ক্রিয় অবস্থান এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বেনগাজিতে জনগণের মার্কিন দূতাবাসে হামলার ঘটনার পরেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, ইদ্রিস আর বেশিদিন টিকতে পারবে না।
ইদ্রিসের রাজকার্যে তেমন কোনো মনোযোগ ছিল না। তার সরকার আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। বিদেশী তেল কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো তেল লুটে নিচ্ছিল। ইদ্রিসের বয়সও হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকানদের সাথে এক মিটিং চলাকালীন সময়েই ইদ্রিস ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফলে আমেরিকানরা তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন সংস্কার আনার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সেসব সংস্কার প্রস্তাবেও ইদ্রিস গুরুত্ব দেয়নি। ফলে একটা অভ্যুত্থান সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সিআইএ অনুমান করছিল অভ্যুত্থান ঘটবে। কিন্তু কে ঘটাবে সেটা তারা জানত না। তারা স্বাভাবিকভাবেই উপরের দিকের অফিসারদের উপর নজরদারি করছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান যে ঘটাবে মাত্র ২৭ বছরের এক ক্যাপ্টেন, এটা তাদের ধারণায়ও ছিল না। লিকড ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, অভ্যুত্থানের সংবাদ শুনে তারা আকাশ থেকে পড়ে।
গাদ্দাফি ছিলেন জামাল আব্দুল নাসেরের বিশাল ফ্যান। ছাত্রকাল থেকেই নাসেরের প্রতিটা ভাষণ ছিল তার মুখস্থ। সাবহায় যখন তিনি হাইস্কুলে পড়তেন, তখন সেখানে বেশ কিছু মিসরীয় শিক্ষক ছিল। তাদের কাছ থেকেই তিনি নাসের সম্পর্কে জানতে পারেন, তার লেখা পড়েন, তার অডিওগুলো সংগ্রহ করেন এবং তার আরব জাতীয়তাবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
প্রায়ই তিনি স্কুলে একটি টুলের উপর দাঁড়িয়ে সহপাঠীদের উদ্দেশ্যে নাসেরের স্টাইলে ভাষণ দেয়ার প্র্যাকটিস করতেন। সে সময়ই তিনি মদের দোকান বন্ধের দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টার দায়ে স্কুল থেকে এবং শহর থেকে বহিষ্কৃত হন।
গাদ্দাফির শাসনামল শুরুর দিকে ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাতারাতি লিবিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি ইসলাম এবং নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। একদিকে তিনি নাইট ক্লাব, মদের বার নিষিদ্ধ করেন, আবার অন্যদিকে নারীদেরকে ক্ষমতায়ন করেন, তাদেরকে রেভোলিউশনার গার্ডসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি দেন।
তিনি আল্টিমেটাম দিয়ে লিবিয়া থেকে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সেনা ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ করেন, লিবিয়ার ৪০,০০০ ইতালিয়ান সেটলার এবং ১২,০০০ ইহুদী সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করেন। তেল কোম্পানিগুলোর সাথে পুরানো চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করতে তাদেরকে বাধ্য করেন।
প্রথম জীবনে গাদ্দাফী সাদ্দামের মতো থাগ বা সিআইএর হেঞ্চম্যান ছিলেন না। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী ছিলেন। ইসরায়েলকে উচ্ছেদ করে তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিজেই তার জনগণের উপর চেপে বসতে থাকেন। দেশের ভেতরে ভিন্নমতকে কঠিনভাবে দমন করতে শুরু করেন। একটা পর্যায়ে আরবের ঐক্যের চেয়ে আরবের নেতা হওয়ার, এবং পরবর্তীতে আফ্রিকার নেতা হওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
বিদেশীরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি আরও সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। আশির দশকে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে গুম করে দেয়া, প্রকাশ্য দিবালোকে তাদেরকে ফাঁসি দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সাথে ঝুলিয়ে রাখা, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িঘর পর্যন্ত বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার নিযুক্ত খুনিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েও লিবিয়ান ডিসিডেন্টদেরকে হত্যা করতে শুরু করে। গাদ্দাফির শাসনমল হয়ে উঠতে থাকে ভীতিময়, পশ্চাৎপদ, শ্বাসরুদ্ধকর।
শুরুর দিকে গাদ্দাফি শুধুমাত্র ইসরায়েলবিরোধী ফিলিস্তিনি গেরিলাদেরকেই সাহায্য করতেন, ট্রেনিং দেওয়াতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আমেরিকা-ইউরোপ-বিরোধী প্রতিটি বিপ্লবী এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথেই গাদ্দাফির কানেকশন তৈরি হতে থাকে। বিশ্বের যেকোনো দেশের সন্ত্রাসীদের জন্য লিবিয়া হয়ে ওঠে অভয়ারণ্য।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ১৫জন অফিসার তাদের পরিবারসহ প্রথম যে দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়, সে দেশটি লিবিয়া। আবু নিদাল, কার্লোস দ্য জ্যাকেলসহ বিশ্বের বড় বড় সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ছিল লিবিয়া। এবং সেই সুযোগে ফ্র্যাঙ্ক তারপিল, এডউইন উইলসনসহ সিআইএ ব্যাকড আর্মস স্মাগলাররাও ছদ্মবেশে গাদ্দাফির আশ্রয় লাভ করে।
আমেরিকার অস্ত্র দিয়েই গাদ্দাফি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে থাকে। সেই সুযোগে অন্যদের চালানো কিছু হামলার দায়ও গাদ্দাফির উপর এসে পড়তে থাকে। এবং জাতিসংঘের অবরোধে লিবিয়ার অর্থনীতির শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতে থাকে। গালফের আরব রাষ্ট্রগুলো যখন ইউরোপকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে, লিবিয়া তখনও পড়ে থাকে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত একটা দেশের কাতারে।
গাদ্দাফি ছিলেন অসাধারণ বিপ্লবী একজন নেতা। কিন্তু প্রথম ৭-৮ বছর পরে লিবিয়াকে তার দেয়ার কিছু ছিল না। এরপর গাদ্দাফির শাসনামল লিবিয়ার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আফ্রিকার “রাজাদের রাজা” হওয়ার লোভ তাকে এতোটাই পেয়ে বসে, নিজের দেশের পেছনে খরচ না করে তিনি আফ্রিকার পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে শুরু করেন।
আমেরিকা পরপর আফগানিস্তান এবং ইরাক আক্রমণ করার পর গাদ্দাফির মধ্যে ভয় চেপে বসে। প্রথম জীবনের বিপ্লবী চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে ততদিনে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকাই তার মূল্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইরাক যুদ্ধ শুরুর পরদিনই তিনি তার ডান হাত মুসা কুসাকে দিয়ে সিআইএ এবং এমআইসিক্সের সাথে যোগাযোগ করান। তার ম্যাসেজ ছিল, তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে শান্তি স্থাপন করতে চান।
শান্তি স্থাপিত হয়। গাদ্দাফি তার পারমাণবিক কর্মসূচী বাতিল করেন। তিনি পশ্চিমের “ওয়ার অন টেরর” এর অংশীদার হয়ে ওঠেন। সিআইএ এবং এমআইসিক্স সন্দেহভাজন লিবিয়ান আল-কায়েদা সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করে লিবিয়াতে রেনডিশন প্রোগ্রামে পাঠায়, আর লিবিয়ানরা জেলগুলোতে তাদের উপর টর্চার চালায়, তাদের মুখ থেকে সিআইএর দেয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করে সেগুলো সরবরাহ করে। গাদ্দাফির শাসনামল হয়ে ওঠে পুরোপুরি পশ্চিমাপন্থী।
ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গাদ্দাফি সব সময়ই কঠোর অবস্থানে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে এই ইসলামপন্থীরাই এমআইসিক্সের সাহায্য নিয়ে গাদ্দাফিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ফলে ওয়ার অন টেরর গাদ্দাফির নিজের জন্যও লাভজনক ছিল। আল-কায়েদা সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, এরা তার বিরুদ্ধে কখনো হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটায় গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম। সাইফ লিবারেল, মডারেট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিলেন। সবার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে লিবিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়াই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি লিবিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতিরও উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করেন।অনেক পলিটিক্যাল প্রিজনারকে ছেড়ে দেন। কাতারের এবং শেখ আলি সাল্লাবির মধ্যস্থতায় আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী যোদ্ধাদেরকেও তিনি মুক্তি দেন।
সেটা ২০১০ সালের কথা। এর এক বছর পর মিসর এবং তিউনিসিয়ার দেখাদেখি যখন লিবিয়াতেও ক্ষুদ্র একটি আন্দোলন শুরু হয়, তখন একদিকে আল-জাজিরা এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম সেটাকে বিশাল করে দেখাতে শুরু করে, অন্যদিকে সাইফের ছেড়ে দেয়া এই আফগান ফেরত ইসলামপন্থী যোদ্ধারা কাতারের দেয়া অস্ত্র নিয়ে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার লড়াইয়ে নেমে পড়ে।
বাকিটা ইতিহাস।
লিবিয়া এবং গাদ্দাফি সম্পর্কে আমার সবগুলো আর্টিকেল পড়ুন এখান থেকে। আর গাদ্দাফির শাসনামল নিয়ে আল-জাজিরার একটি সুন্দর ডকুমেন্টারি আছে, দেখতে পারেন এখান থেকে।
ভালো লেখা, সময় করে আরেকটু বিস্তারিত লেইখেন।