যেভাবে একজন স্বৈরাচরী হবেন: নেটফ্লিক্সের ডকু সিরিজ

দেখলাম নেটফ্লিক্সের ডকুমেন্টারি মিনি-সিরিজ, How to Become a Tyrant (2021)। যদিও কিছু ক্ষেত্রে বায়াসড এবং ওভার সিমপ্লিফিকেশনের দোষে দুষ্ট, তারপরেও ওভার অল দুর্দান্ত একটা ডকুমেন্টারি। অতি অবশ্যই মাস্ট-ওয়াচ।

আপনার আশেপাশের নতুন নতুন স্বৈরশাসকদের দিকে তাকালে আপনি প্রায়ই দেখবেন, তাদের মধ্যে ক্লাসিকাল স্বৈরশাসকদের অনেক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একদিকে তারা কবিতা লিখতে পছন্দ করে, ফুল ভালোবাসে, শিশুদেরকে আদর করে, জনগণের চিন্তায় তাদের রাতে ঘুম আসে না।

অন্যদিকে তারা নিজেদের নামে দেশের সবকিছুর নামকরণ করে, নির্লজ্জভাবে দেশের ইতিহাস বিকৃত করে, গুম-খুনের রাজত্ব কায়েম করে, কৃত্রিম শত্রু তৈরি করে দেশের সব সমস্যার জন্য তাদেরকে দায়ী করে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, দেশের ভেতরে সঙ্কট বেড়ে গেলে কৃত্রিমভাবে নতুন সঙ্কট করে জনগণের দৃষ্টি সেদিকে ফেরানোর চেষ্টা করে।

দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের মধ্যে এত মিল লক্ষ্য করলে আপনার মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে, সফল স্বৈরশাসক হওয়ার জন্য হয়তো সিক্রেট কোনো প্লেবুক আছে। ওয়ান্নাবি স্বৈরশাসকরা সেই সিক্রেট প্লেবুক অনুসরণ করেই দেশ শাসন করে।

এই ডকুমেন্টারিটা ঠিক সেই বিষয়টা নিয়েই – টাইর‍্যান্টদের সিক্রেট প্লেবুক এবং সেটা অনুসরণ করে করে আপনি কীভাবে একজন সফল টাইর‍্যান্ট হতে পারবেন। সিরিজে মোট ছয়টা এপিসোড। প্রতিটা এপিসোডে একেকজন করে টাইর‍্যান্টকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং তার জীবনীর উপর ভিত্তি করে সফল টাইর‍্যান্ট হওয়ার একেকটা। কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে।

যেমন সফল টাইর‍্যান্ট হতে হলে প্রথমেই আপনাকে ক্ষমতায় বসতে হবে। এর জন্য প্রথম এপিসোডে (Seize Power) দেখানো হয়েছে হিটলারের জীবনী – কীভাবে, কী কী পদক্ষেপ এবং কৌশল অবলম্বন করে সাধারণ একজন সৈনিক এবং হতভাগ্য মিডিওকার একজন পেইন্টার থেকে হিটলার জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

দ্বিতীয় এপিসোডে (Crush Your Rivals) দেখানো হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের কথা। কারণ ক্ষমতা দখল করলেই তো হবে না, ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকেও তো নির্মূল করতে হবে! আর এই কাজটা সাদ্দামের চেয়ে ভালো কে পেরেছে, যে বাথ পার্টির নিজের সহকর্মীদেরকে তো বটেই, নিজের দুই মেয়ের জামাইকে পর্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে?

আরও পড়ুন: নেটফ্লিক্সের গাদ্দাফি এপিসোড: কতটুকু সত্য? কতটুকু প্রপাগান্ডা?

প্রতিন্দ্বন্দ্বীদেরকে সরানোর পর আসে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা – জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি করার কথা, যেন কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করার সাহস না দেখায়। আর এজন্য তৃতীয় এপিসোডে (Reign Through Terror) দেখানো হয়েছে উগান্ডার ইদি আমিন দাদার জীবনী।

একইভাবে চতুর্থ এপিসোডে (Control The Truth) স্ট্যালিনের জীবনী পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে প্রোপাগান্ডার শক্তি, পঞ্চম এপিসোডে (Create A New Society) গাদ্দাফিকে দিয়ে দেখানো হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ, শিক্ষা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া।

এবং নিজের দেশকে পুরো দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে, বিভিন্ন মিথ সৃষ্টি করে স্বৈরশাসন কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকিয়ে রাখা যায়, সেটা দেখানো হয়েছে শেষ এপিসোডে (Rule Forever), উত্তর কোরিয়ার কিম ডাইনেস্টির শাসন পর্যালোচনার মাধ্যমে।

এ ধরনের ডকুমেন্টারিতে যেরকম হওয়ার কথা, সেরকম এটাতেও অনেকক্ষেত্রেই যেখানে নুয়্যান্সড ভিউ দেখানো সম্ভব, সেখানেও ডকুমেন্টারির মূল বক্তব্য সহজে তুলে ধরার জন্য ওভার সিমপ্লিফাই করা হয়েছে। ডিক্টেটরদের বিরুদ্ধে শোনা কথাকেও অনেক সময় ফ্যাক্ট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

গাদ্দাফি সংক্রান্ত এপিসোডটা দেখতে গিয়ে এটা ভালোভাবে টের পেয়েছি। অন্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত না জানায় হয়তো সেগুলোর সবগুলো ত্রুটি ধরতে পারিনি, কিন্তু বোঝা যায় সেগুলোতেও অতিরিক্ত সরলীকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া সিরিজটাতে স্বৈরশাসকদের এমন অনেক দোষ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে, যেগুলো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শাসকদের মধ্যেও আছে।

তবে সকল দোষত্রুটি সত্ত্বেও সিরিজটা চমৎকার। এটা দেখার পর আপনার আশেপাশের স্বৈরশাসকরা কী করছে, কেন করছে, সেটা বোঝা আপনার জন্য আরও সহজ হবে।

সিরিজটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর ভয়েস ওভার। গেম অফ থ্রোন্স যারা দেখেছেন, পিটার ডিঙ্কলেজ তথা টিরিয়ন ল্যানিস্টারের স্ট্রং ভয়েসের সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নাই।

সিরিজটা মাস্ট ওয়াচ। নেটফ্লিক্সে তো আছেই, টরেন্টেও পাবেন। পার্সোনাল রেটিং ৮/১০।

গাদ্দাফির এপিসোডটার কতটুকু সত্য, কতটুকু সরলীকরণ, সেটা নিয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছি এখানে

মুভি-সিরিয়াল সম্পর্কিত আমার সবগুলো লেখা একত্রে পাবেন এই লিঙ্কে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *