মুভি রিভিউ,  লিবিয়ার রাজনীতি

নেটফ্লিক্সের গাদ্দাফি এপিসোড: কতটুকু সত্য? কতটুকু প্রপাগান্ডা?

নেটফ্লিক্সের How to Become a Tyrant এর পঞ্চম পর্বটা সাবেক লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে নিয়ে – কীভাবে গাদ্দাফি পুরো সমাজব্যবস্থাকেই নতুন করে গড়ে তুলেছিল।

এপিসোডটা মোটের উপর ভালো। এটার শুরুটাও ভালো ছিল। এখানে স্বীকার করা হয়েছে, গাদ্দাফি শুরুতে জেনুইনলিই মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটা রাষ্ট্রের জনগণকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে নিজেই নিজেকে দেশের জন্য অপরিহার্য্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।

গাদ্দাফির যে সমালোচনাগুলো করা হয়েছে, তার অনেকগুলোই জেনুইন। গাদ্দাফি আসলেই সব ধরনের প্রেস ফ্রিডম, ট্রেড ইউনিয়ন, স্টুডেন্ট ইউনিয়ন – সোজা কথায় সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সব ধরনের উপায়কে নিষিদ্ধ করেছিল। এবং ৭৬ সালের ৭ই এপ্রিল সত্যিসত্যিই ছাত্র আন্দোলনের আয়োজকদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল।

কিন্তু এর বাইরে গাদ্দাফির এমন কিছু সমালোচনা করা হয়েছে, যেগুলো জাস্ট খুঁজে খুঁজে সমালোচনা করা। যেমন গাদ্দাফির গ্র্যান্ড প্রজেক্ট – দ্য গ্রেট ম্যান মেড রিভার প্রজেক্ট। সাহারার মাটির নিচের ন্যাচারাল অ্যাকুইফারে যে বিপুল পরিমাণ পানি মজুত আছে, সেটাকে পাম্পের সাহায্যে উত্তোলন করে হাজার হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত পাইপলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে পৌঁছে দেওয়া।

এই প্রজেক্টটা সত্যিকার অর্থেই একটা মেগা প্রজেক্ট। এবং এটা লিবিয়ানদের জীবন-যাপনকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। ত্রিপোলিতে এক বৃদ্ধের মুখে শুনেছিলাম, গাদ্দাফি ক্ষমতায় আসার আগে খোদ রাজধানী ত্রিপোলির সেন্টারেও সাধারণ মানুষের সুপেয় পানির জন্য কী পরিমাণ কষ্ট করতে হতো। সেই বৃদ্ধ তখন ছোটো ছিল। প্রতিদিন সে বালতি হাতে করে ইহুদী কোয়ার্টারে গিয়ে পানির জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। কারণ তাদের ঐ এলাকায় একমাত্র ইহুদী কোয়ার্টারেই পানির কূপ ছিল।

নাইন্টিজে আমরা নিজেরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও ম্যান মেড রিভারের পানি মিসরাতায় এসে পৌঁছেনি। সে সময় প্রতি ২০-২২ দিন পরপর আব্বু পিকআপ ট্রাক ভাড়া করত ২৫ কিলোমিটার দূরের একটা রেসিডেনশিয়াল প্রজেক্ট থেকে ফিল্টার করা পানি আনার জন্য। আমাদের বাসা ছিল চার তলায়। গ্যালন ভরা সেই পানি আমরা টেনে টেনে চারতলা পর্যন্ত উঠাতাম। অথচ ম্যান মেড রিভার প্রজেক্টের কল্যাণে এখন দুর্গম সাহারার মোটামুটি জনবসতির শহরগুলোতেও মানুষের বাসায় বাসায় সুপেয় পানির সাপ্লাই।

তাছাড়া এই প্রজেক্টের মাধ্যমে খুবই কম বৃষ্টিপাতের এলাকাগুলোতেও বিশাল বিশাল অ্যাগ্রিকালচারাল ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছিল। গুগল ম্যাপে গেলেও দেখা যায় ধু-ধু মরুভূমির মধ্য বিশাল বিশাল ক্রপ সার্কেল। কিন্তু ডকুমেন্টারিতে এটারও নেতিবাচক সমালোচনা করা হয়েছে। দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, সেটা মানলাম। কিন্তু এটাও বলা হয়েছে, গাদ্দাফি নাকি লিবিয়ার মাটির নিচে থাকা পানি “এক্সপ্লয়েট” করেছে। এক্সপ্লয়েট কাকে বলে, সেটাই বুঝলাম না।

আরও পড়ুন: যেভাবে একজন স্বৈরাচরী হবেন: নেটফ্লিক্সের ডকু সিরিজ

ডকুমেন্টারিতে গাদ্দাফির শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের সমালোচনা যৌক্তিক। গাদ্দাফি আসলেই ইংরেজি শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং তার রচিত দ্য গ্রিন বুককে পাঠ্য করেছিল। একইসাথে ১৯৮৪ সালে বেনগাজি স্টেডিয়ামে যে এক ছাত্রকে, এবং এরপর আরো অনেককে যে প্রকাশ্য জনসভায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তার সমালোচনাও যৌক্তিক।

কিন্তু এই সমালোচনার একটা সমস্যা সব সময়ই চোখে পড়ে – সেটা হচ্ছে এসবক্ষেত্রে ভিক্টিমকে পুরোপুরি নির্দোষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। টু বি ফেয়ার, ভিক্টিম অপরাধী হলেও তড়িঘড়ি করে বিচার করে, জনসমক্ষে, বিশেষ করে বাচ্চাদের সামনে ফাঁসিতে ঝুলানো মানবতা-বিরোধী অপরাধ। কিন্তু ভিক্টিমের দোষ উল্লেখ না করলে ডিক্টেটরকে মনস্টার বা সাইকো বলে মনে হয় – যে সম্পূর্ণ নির্দোষ মানুষকে হত্যা করছে। বাস্তবে অনেক ডিক্টেটরই সেরকম মনস্টার বা সাইকো না। বরং তারা ক্ষমতালোভী, এবং ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য তারা ঠাণ্ডা মাথায় বিদ্রোহীদেরকে হত্যা করে।

গাদ্দাফির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল। সিআইএ সে সময় চাদে লিবিয়ান বিদ্রোহীদেরকে মিলিটারি ট্রেনিং দিচ্ছিল গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। এবং বেনগাজি স্টেডিয়ামের ঐ হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েকমাস আগেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের অর্থায়নে একটা ইসলামিস্ট গ্রুপ গাদ্দাফির বাসভবনে হামলা চালিয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে জনসমক্ষে ফাঁসির সমালোচনার পাশাপাশি এই অ্যাঙ্গেলটাও উল্লেখ করা জরুরী।

ডকুমেন্টারিতে গাদ্দাফির আরেকটা টিপিক্যাল সমালোচনা করা হয়েছে তার নারী বডিগার্ডদেরকে নিয়ে। এটা সত্য, গাদ্দাফি লিবিয়ার নারীদেরকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছিল এবং তার নিজেরও ফিমেল বডিগার্ডের একটা স্পেশাল ইউনিট ছিল। কিন্তু নারীদেরকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়াটা প্রথম জীবনে বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত গাদ্দাফির নারীর ক্ষমতায়নেরই একটা অংশ।

আর তার নারী বডিগার্ডদের সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক, কিংবা কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে তাকে তুলে নিয়ে রেপ করার যে কাহিনী, সেগুলো জাস্ট পশ্চিমা প্রপাগান্ডা। এটা ২০১১ সালে গাদ্দাফির সৈন্যদের মধ্যে ভায়াগ্রা বিতরণের মতোই স্টোরি, যা গাদ্দাফি-বিরোধী লিবিয়ানরাও বিশ্বাস করে না। কোনো এক চরম গাদ্দাফি বিদ্বেষী লিবিয়ান হয়তো কখনও এটা দাবি করেছে, এরপর থেকে কোনো প্রমাণ ছাড়া, যথেষ্ট সংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ছাড়া সেটাকেই পশ্চিমা মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।

আরও পড়ুন: গাদ্দাফির শাসনামলের ১০টি অবিশ্বাস্য সুবিধা: কতটুকু বাস্তব, কতটুকু প্রপাগান্ডা?

দুই দিন আগে এই ডকুমেন্টারিটা আমি দেখছিলাম সাইট ভিজিটে যাওয়ার সময় গাড়িতে বস বসে। তখন আমার পাশে গাড়ি ড্রাইভ করছিল আমার লিবিয়ান কলিগ, ফরজ জাওয়াওই। সে গাদ্দাফিকে দেখতে পারে না। এবং ২০১১ সালে সে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। সিরত যুদ্ধেও সে অংশগ্রহণ করেছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই নারী বডিগার্ড বা রেপ স্টোরি সম্পর্কে তার কী ধারণা? সে এক কথায় উত্তর দিলো – প্রপাগান্ডা। গাদ্দাফি স্বৈরাচার ছিল, লিবিয়ার উন্নতি করেনি, কিন্তু মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে রেপ করবে, এটা অবাস্তব।

লিবিয়ার ট্রাইবাল সোসাইটি সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তারা এটা এমনিতেই বুঝতে পারার কথা। ২০১৫-২০১৬ সালে যখন লিবিয়ার বিশাল এলাকা আইএসের দখলে ছিল, তখন তারা প্রচুর লিবিয়ান পুরুষকে জাস্ট সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে গেছে, শিরশ্ছেদ করে হত্যা করেছে। কিন্তু তারাও কোনো লিবিয়ান মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস পায়নি। লিবিয়ান সোসাইটিতে এটা রেড লাইন। গাদ্দাফি যদি এরকম কিছু করত, তাহলে সে এত বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এবং তার জনপ্রিয়তাও এত থাকত না।

ডকুমেন্টারির আরেকটা হাস্যকর দিক হচ্ছে, এখানে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে একাধিকবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ফুটেজ দেখানো হয়েছে। এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইটের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাদের তো গাদ্দাফির ব্যাপারে নিরপেক্ষ কোনো মন্তব্য করার যুক্তি নাই! ১৯৮৬ সালে গাদ্দাফির বাসভবনের উপর যে আমেরিকা বিমান হামলা করেছিল, সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে এমনভাবে, যেন সব দোষ গাদ্দাফির। অথচ ঐ ঘটনায় আমেরিকা গায়ে পড়ে লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে গাদ্দাফিকে উস্কে দিয়েছিল।

তবে এই ডকুমেন্টারিতে একটা দারুণ ব্যাপার বলা হয়েছে, যেটা লিবিয়ানরা সব সময় বলে, আমি নিজে অনেকবার বলেছি, কিন্তু এর আগে অন্য কোনো মিডিয়াকে বলতে দেখিনি। সেটা হচ্ছে, গাদ্দাফির পতনের অন্যতম প্রধান কারণ, শেষ বয়সে গাদ্দাফি সফট হয়ে গেছিল। ইরাক যুদ্ধের পর গাদ্দাফি ভয় পেয়ে আমেরিকার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিল, মানবাধিকার সংক্রান্ত রেকর্ডে গুডবুকে ওঠার জন্য বছরের পর বছর আটকে রাখা বিদ্রোহীদেরকে, ইভেন আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত জিহাদিদেরকেও ক্ষমা করে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছিল।

এবং সেটাই হয়েছে তার কাল। ২০১০ সালে তাদেরকে জেল থেকে ছাড়ার মাত্র আট মাসের মাথায়, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন এরাই গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং ডকুমেন্টারির শেষের যে শিক্ষাটা – স্বৈরাচার হিসেবে টিকে থাকতে হলে সফট হওয়া যাবে না – সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সেটা ভালো না খারাপ, সেটা ভিন্ন বিতর্ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *