সো, নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম অনুযায়ী, গাদ্দাফি’জ সান ওয়ান্টস টু টেক লিবিয়া ব্যাক!
সন্দেহ নাই, সাইফের নিজেরও সেরকমই ইচ্ছা। ফিরে আসার নিউজটা তাই সে ইজিপ্ট-বেজড নিজেদের জামাহিরিয়্যা টিভিতে দেয়নি। বা আরব কোনো মিডিয়াতে দেয়নি। দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসে। টার্গেট ইন্টারন্যাশনাল অডিয়েন্স।
সে দেখতে চায়, এই শিরোনামের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী হয়। কারণ দেশের ভেতরের আইন, সংবিধান হয়তো ম্যানেজ করা সম্ভব, কিন্তু সাইফ যদি আসলেই লিবিয়ার রাজনীতিতে ফিরে আসতে চায়, তাহলে তার সামনে অন্যতম প্রধান বাধা হবে তার বিরুদ্ধে জারি থাকা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের ওয়ারেন্ট।
এখন কথা হচ্ছে, সাইফের পক্ষে কি আসলেই লিবিয়ার সেভিয়ার হওয়ার যৌক্তিক সম্ভাবনা আছে? উত্তরটা জটিল। যদি এই মুহূর্তে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশান দিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেখানে সাইফকে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়, সে চোখ বন্ধ করে জিতে আসবে।
আর্টিকেলেও সেরকম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। টাইমসের রিপোর্টারের দাবি অনুযায়ী, রমজান মাসে সে ত্রিপোলিতে একটা ক্যাফেতে চারজন লিবিয়ান ইয়ুথকে জিজ্ঞেস করেছিল নির্বাচনে কাকে সাপোর্ট করবে, তিনজনই উত্তর দিয়েছে সাইফকে। এক আইনজীবী রিপোর্টারকে বলেছে, তার নিজস্ব জরিপ অনুযায়ী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ থেকে ৯ জন সাইফকে ভোট দিবে।
অবশ্য আমার ধারণা এই অনুমান অতিরঞ্জিত। সিরত, সাবহা, বানিওয়ালিদ-সহ লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এই সংখ্যা সঠিক হতে পারে। এমনকি ত্রিপোলির আবু-সেলিম, হাদবা এবং আরও কিছু এলাকায়ও চিত্রটা এর কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু মিসরাতা, জাওইয়া তো বটেই, ত্রিপোলিরও তাজুরা বা সুক্ব জুমায় এরকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। সোজা কথায়, নির্বাচন হলে সাইফ জিতবে ঠিকই, কিন্তু সেটা এত ড্রামাটিক্যালি না।
আরও পড়ুন: বিবিসিতে আমার সাক্ষাৎকার: সাইফ কি পারবে ক্ষমতায় ফিরতে?
কিন্তু সমস্যাটা হবে, সাইফকে কেউ নির্বাচনে দাঁড়াতেই দিবে না। যারা এখন ক্ষমতায় আছে, যেসব সশস্ত্র মিলিশিয়ারা গত দশ বছর ধরে দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নিজেদের বিভেদ ভুলে গিয়ে সাইফের পুনরুত্থান ঠেকাতে। ইনফ্যাক্ট সাইফ যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে, সেজন্য প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন দেওয়ার ব্যাপারেই বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কেউ রাজি হবে না। নির্বাচন যদি হয়ও, সেটা হবে সংসদীয় পদ্ধতির।
যদি কোনোভাবে সাইফ ক্ষমতায় আসেও, তাহলেও কি কিছু পরিবর্তিত হবে? খুব সম্ভবত, না। কারণ সাইফের যে জনপ্রিয়তা বা আত্মবিশ্বাস, তার পেছনে তার নিজের তেমন কোনো অবদান নাই। আছে গত ১০ বছরের ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা। এবং আছে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সাইফের করে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণী।
সাইফ বলেছিল, লিবিয়ায় রক্তের বন্যা বয়ে যাবে, লিবিয়ানরা গোত্রে-গোত্রে বিভক্ত হয়ে যাবে, গৃহযুদ্ধে লিবিয়া বিভক্ত হয়ে যাবে, টাকার জন্য ব্যাঙ্কে আর পেট্রোলের জন্য ফুয়েল স্টেশনে মানুষকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তার প্রায় প্রতিটা ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস এমনভাবে লিবিয়াকে গ্রাস করে নিয়েছে, এবং তার ফলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কিছু না করেই সাইফ হয়ে গেছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিগার।
কিন্তু খুব বেশি সম্ভাবনা আছে, যেই মুহূর্তে সাইফ রাজনীতির ময়দানে পা রাখবে, সেই মুহূর্ত থেকে সে নিজেও একের পর এক ভুল করতে শুরু করবে। ফলে তার জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেতে শুরু করবে। অন্তত লিবিয়াকে সেভ করার জন্য যেরকম একজন ফাদার ফিগার দরকার, যে শক্ত হাতে দেশ শাসন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় রিকনসিলিয়েশনের দিকেও নজর দিবে, সাইফ সম্ভবত সেরকম কিছু হবে না।
এই আর্টিকেলেও সেরকমই ইঙ্গিত দেখা গেছে। একসময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা সাইফ ২০১১ সালে যে সুর পরিবর্তন করেছিল, এত বছর পরেও সে তার সেই অবস্থান থেকে ফিরে আসেনি।
২০১১ সালে যারা আন্দোলন করেছিল, তাদের প্রতি সে কোনো সহানুভূতি অনুভব করে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলেছে, তারা সবাই ইভিল পিপল, টেরোরিস্ট, এবং ডেভিল। ১৯৯৬ সালে আবু সেলিম কারাগারে ১২০০ বন্দীকে গণহত্যার ব্যাপারে সে বলেছে, অধিকাংশ লিবিয়ানকে জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর দিবে, ওটা বরং কমই ছিল। সেখানকার বাকি বন্দীদেরকেও শেষ করে দেওয়া উচিত ছিল।
এই আর্টিকেলের মধ্য দিয়ে তাই সাইফের বেঁচে থাকার নিউজই না, একইসাথে তার ভিশনও কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। এবং এক্ষেত্রে তার পোশাক এবং পাগড়ির চয়েসটাও সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত এরকম রাজকীয় সেটিংয়ে লম্বা আলখাল্লা এবং পাগড়ির মতো অদ্ভুত পোশাক পরে সে তার বাবার ফ্যাশন এবং স্টাইলের প্রতিই ট্রিবিউট দিতে চেয়েছে। হয়তো সে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে – দেখ, আমি আমার বাবার মতোই।
কিন্তু যেটা আগে বলেছি, রাজনীতির ময়দানে পা দেওয়ামাত্রই সে ভুল করতে শুরু করবে, এই ছবির মধ্য দিয়েই সেটার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তার এই স্টাইলে তোলা ছবি লিবিয়ানদেরকে উদ্দীপ্ত করার পরিবর্তে কনফিউজ করে দিয়েছে। এমনিতেই ১০ বছর বন্দী থেকে তার চেহারায় পরিবর্তন এসেছে, বার্ধক্যের ছাপ এসেছে। তার উপর কাঁচা-পাকা লম্বা দাড়ি এবং মাথা ঢাকা পাগড়িতে তাকে চিনতেই মানুষের কষ্ট হচ্ছে।
অনেক লিবিয়ানই বরং সন্দেহ করছে – এটা আসলেই সাইফ, নাকি তার ভাই সা’দি? এটা কি জেনুইন সাক্ষাৎকার? নাকি লিবিয়ার বিরুদ্ধে “পশ্চিমা মিডিয়া”র নতুন কোনো ষড়যন্ত্র?