লিবিয়া,  লিবিয়ার রাজনীতি

লিবিয়ার আরব বসন্তে মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব

দেশে বসন্ত গেছে গতকাল, যদিও কেউ কেউ পরশুদিনও পালন করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের বসন্ত আজ। না, ঋতুরাজ বসন্ত না, আরব বসন্ত। অফিশিয়ালি যদিও আরব বসন্তের লিবিয়ান ভার্সনের শুরুটা ১৭ই ফেব্রুয়ারি বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে সেটা শুরু হয়েছিল ১৫ তারিখেই।

২০১১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির আগে জীবনে কোনোদিন মিছিল দেখিনি। টিভিতে দেখেছি। সরকারিভাবে আয়োজিত ফিলিস্তিনের জন্য মিছিল, লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলার বিরুদ্ধে মিছিল, আমেরিকার কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিল। কিন্তু রাস্তায় সরাসরি নিজের চোখে কোনোদিন মিছিল দেখিনি।

দেখা সম্ভবও ছিল না। বিশ্বের অন্য সব একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে লোক দেখানো হলেও পার্লামেন্ট বা লোকাল কাউন্সিল নির্বাচন হয়। কিন্তু গাদ্দাফির লিবিয়াতে কোনো ধরনেরই নির্বাচন হতো না। নির্বাচনই যেখানে নাই, জনপ্রতিনিধিই যেখানে নাই, সেখানে ছোটখাট দাবিতে আন্দোলন-মিছিল হওয়া সম্ভব না। সেখানে একটাই জিনিস হতে পারে – চূড়ান্ত আন্দোলন – সিস্টেম পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন। আশ্‌শা’ব ইউরিদ এসক্বাত আন-নেজাম – পিপল ওয়ান্ট দ্য ডাউনফল অফ দ্য রেজিম।

১৫ তারিখের আগে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না, লিবিয়াতে কোনো আন্দোলন হতে পারে। সকালবেলা ভার্সিটিতে ক্লাস, ফাঁকে ফাঁকে একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে পার্টটাইম জব, বিকেলে বাংলাদেশী স্কুলে শিক্ষকতা, রাতে আবার প্রাইভেট টিউশনি – অকল্পনীয় রকমের ব্যস্ততায় তখন সময় পার করছিলাম। ঘুমানোর পর্যন্ত সময় ছিল না। তিউনিসিয়া আর মিসরের সরকার পতনের সংবাদ আসতে-যেতে দূর থেকে শুনছিলাম, ক্লোজলি ফলো করার মতো টাইম ছিল না। লিবিয়াতে কী হতে পারে – সেই অনুমান তো অনেক দূরের কথা।

কাজেই ১৫ তারিখ সকাল বেলা ভার্সিটি যাওয়ার সময় যখন দেখলাম শহরের সেন্ট্রাল স্কয়ারে মানুষ পতাকা আর ব্যানার নিয়ে জড়ো হচ্ছে, শ্লোগান দিচ্ছে, তখন আমি পুরোপুরি আকাশ থেকে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য ভুল করে বসলাম – এখানেও কি গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে গেল? পরমুহূর্তেই ভুল ভাংলো। সিরত গাদ্দাফির জন্মস্থান। অন্য যেকোনো শহরে হলেও হতে পারে – সিরতে গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনের প্রশ্নই ওঠে না।

ট্যাক্সি ততক্ষণে স্কয়ার পেরিয়ে গেছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম কাহিনী কী? সে উত্তর দিলো, মিছিল হচ্ছে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে। আল-জাজিরার দোষ কী? আল-জাজিরা নাকি লিবিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। লিবিয়ায় তখনও কোথায় কিছু ঘটেনি, কিন্তু আল-জাজিরা প্রচার করা শুরু করেছে, গাদ্দাফির শাসনে অতিষ্ঠ লিবিয়ানরা তার পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আল-জাজিরার দাবি যে মিথ্যা, সেটা প্রমাণের জন্যই মানুষ রাজপথে জড়ো হচ্ছে।

সেদিন ক্লাস হয়েছিল কিনা, এখন আর মনে নাই। কিন্তু দুপুর বেলা যখন ভার্সিটি থেকে বের হলাম, ততক্ষণে পুরো শহরের জনতার ঢল রাজপথে ভেঙ্গে পড়েছে। সিরতের জনসংখ্যা এক লাখ। মিছিলে যেতে সক্ষম পুরুষের সংখ্যা যদি ৪০ হাজার হয়, আমার ধারণা ৩৫ হাজার মানুষই সেদিন রাজপথে নেমে এসেছে। সবার হাতে হাতে গাদ্দাফির ছবি অথবা সবুজ পতাকা। লিবিয়াতে এগুলো প্রস্তুত করতে সময় লাগে না। প্রতিটা অফিসে, দোকানে, মানুষের ঘর-বাড়িতে গাদ্দাফির বিশালাকর ছবি থাকে। আর পতাকা তো কেবল সবুজ কাপড়ের টুকরা!

সেদিনই প্রথম শ্লোগান শুনলাম – আল্লাহ, ওয়া মোয়াম্মার, ওয়া লিবিয়া, ওয়া বাস্‌! অর্থাৎ, আল্লাহ, গাদ্দাফি, আর লিবিয়া – এটাই আমাদের সব!

সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছিল চলল। পরদিন মিছিল হলো আরো বিশাল। সেদিন মহিলারাও যোগ দিলো। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত শুধু সবুজ পতাকা হাতে মানুষ আর মানুষ। রাস্তা নয়, যেন সবুজ রংয়ের নদী।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে এতো বড় মিছিল, বিশ্বের কোনো মিডিয়া এই মিছিলের সংবাদ কভার করেনি। পশ্চিমা মিডিয়া অবশ্য তখনও লিবিয়ার উপর ফোকাস শুরুই করেনি। কিন্তু আল-জাজিরা তখনও ঘণ্টায় ঘণ্টায় লিবিয়ার নিউজ প্রচার করছিল। ১৫ তারিখ বিকেলে গাদ্দাফির নিরাপত্তাবাহিনী এক আই্নজীবিকে গ্রেপ্তার করেছিল, সেই সংবাদও উঠে এসেছিল আল-জাজিরায়। সেদিন রাতে শখানেক মানুষ, প্রধানত মহিলা, বেনগাজিতে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মিছিল শুরু করেছিল। সেই মিছিলের নিউজও প্রচার করেছিল আল-জাজিরা। কিন্তু সিরতে এবং আরো কিছু শহরে এতো বিশাল মিছিল তারা প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা তারা বোধ করেনি।

লিবিয়ার বসন্তের পেছনে গাদ্দাফির দীর্ঘকালীন একনায়কতান্ত্রিক শাসন, প্রতিপক্ষকে গুম-খুন, এবং শেষে আন্দোলন দমনে ভুল পদক্ষেপও দায়ী। কিন্তু এই বসন্ত পুরোপুরি প্রাকৃতিক বসন্তও ছিল না। অন্তত মিডিয়ার উস্কানি বেশ ভালোভাবেই ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *