ভার্সিটিতে আমাদের প্রথম ক্লাসটা ছিল ম্যাথ ওয়ানের। প্রফেসর ছিল একজন সিরিয়ান। ভর্তি হওয়ার আগে শুনেছিলাম, পুরো ইউনিভার্সিটিতে অন্য সব ফ্যাকাল্টিতে পড়াশোনা আরবিতে হলেও কেবলমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সবকিছু হবে ইংরেজিতে। লেকচার অবশ্য আরবিতেই হবে, কিন্তু প্রশ্নোত্তর, লেকচার শিট, রেফারেন্স বই সব হবে ইংরেজি।
ভেবেছিলাম যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং, তাই লেকচার আরবিতে হলেও আর কতটুকু হবে? বেশিরভাগই তো থাকবে ইকুয়েশন আর ম্যাথ – সেগুলোর আর আরবিই কী, ইংরেজিই কী? কিন্তু ক্লাসে ঢুকেই আমার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার জোগাড়। সিরিয়ান প্রফেসর ভদ্রলোক একেবারে বিশুদ্ধ আরবিতে গড়গড় করে লেকচার দিয়ে যাচ্ছে, যার শতকরা ৬০ ভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
বকবকানি থামিয়ে যখন বোর্ডে ইকুয়েশন লিখতে শুরু করল, তখন ভাবলাম, যাক এবার সমস্যা হবে না। কিন্তু দেখি ইকুয়েশনও যেভাবে পড়ছে, তার কিছুই বুঝি না। মুজেব মানে যে প্লাস, আর সালেব মানে যে মাইনাস, সেটাই আমি দুই ঘন্টার লেকচারে ধরতে পারিনি। ক্লাস শেষে এক লিবিয়ান স্টুডেন্ট ব্যাখ্যা করে দেওয়ার পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
সেদিনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম, আমরা যেরকম ভাষার মধ্যে প্রচুর ইংরেজি ব্যবহার করি, ইকুয়েশনগুলো, বিভিন্ন ম্যাথম্যাটিকাল এবং সায়েন্টিফিক টার্ম ইংরেজিতেই পড়ি, আরবরা সেরকম করে না। তারা পারলে সবকিছুর আরবি করে ফেলে।
আমরা যেরকম অজানা রাশি হিসেবে x আর y ধরে সমীকরণ সমাধান করি, সেটাও ওরা করে আরবিতে। এক্স আর ওয়াইয়ের পরিবর্তে ওরা ধরে সোয়াদ (ص) আর সীন (س)।
রসায়ানের সমীকরণগুলোও ওরা অনেকক্ষেত্রে আরবি করে ফেলে। যেমন সালফারকে বলে ক্যাব্রিত, সেই হিসেবে সালফার ডাই অক্সাইডকে বলে তানি অক্সিদ আল-ক্যাব্রিত! আয়রনকে বলে হাদিদ। সেই হিসেবে আয়রনের যৌগকে তো আরবিতে ট্রান্সলেট করেই, আস এবং ইককে ট্রান্সলেট করতে না পেরে সেটাকে আরবিকরণ করে আরবি নামের সাথে মিলিয়ে দেয়।
যেমন ফেরাস সালফেটকে বলে ক্যাব্রিতাত আল-হাদিদুস (হাদিদ+আস = হাদিদাস > হাদিদুস)। আর ফেরিক সালফেট সালফেটকে বলে ক্যাব্রিতাত আল হাদিদিক (হাদিদ+ইক)! এখন ইকুয়েশন শিখব, নাকি বসে বসে সেগুলোর আরবি অনুবাদ আর ব্যাকরণ শিখব?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য খুব কষ্ট হয়নি। ম্যাথের গ্রুপ পাল্টে এক মিসরীয় প্রফেসরের গ্রুপে চলে গেছিলাম। অসাধারণ শিক্ষক ছিল। বাকি প্রফেসররাও যখন বুঝতে পারত বিদেশী বলে আরবিতে সমস্যা হচ্ছে, তখন নিজেই বাড়তি টাইমে ক্রিটিক্যাল অংশগুলো আবার ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করে দিত।
কিন্তু প্রথম কয়েক সপ্তাহেই যে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এরপর থেকে “সর্বস্তরে বাংলা ভাষা”র প্রচলন কথাটা শুনলেই সেই সর্বস্তরে আরবির বিভীষিকার কথা মনে পড়ে যায়।