গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই লেখাটি লিখেছিলাম। প্রকাশিত হয়েছিল বিডিনিউজ ২৪ ডট কমে “লিবিয়ায় যেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা” শিরোনামে। এতে ঐ সময় পর্যন্ত লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের পরিস্থিতির পাশাপাশি লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র উঠে এসেছে।
প্রবাসগমনে ইচ্ছুক বাংলাদেশীদের জন্য লিবিয়া সব সময়ই আকর্ষণীয় একটা দেশ ছিল। লিবিয়াতে যাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, উপার্জন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় ভালো, কাগজপত্রের বৈধতা নিয়ে খুব বেশি কড়াকড়ি নেই, পুলিশি হয়রানি নেই, এবং সবচেয়ে বড় কথা, লিবিয়া হচ্ছে স্বপ্নের ইউরোপে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ, সস্তা এবং জনপ্রিয় রুট। কিন্তু এ সবই গাদ্দাফির আমলের কথা। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার ষষ্ঠ বর্ষপূর্তি আসছে কয়দিন পরেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গাদ্দাফির পতনের পাঁচ বছর পর বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য লিবিয়া কতটুকু বসবাসযোগ্য?
গাদ্দাফির পতনের পরপর, ২০১২ এবং ২০১৩ সাল ছিল লিবিয়া প্রবাসীদের জন্য স্বর্ণযুগ। দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসনের অবসানে বিভিন্ন ধরনের বাধা উঠে যাওয়ায় লিবিয়ানদের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে এবং তার সুফল লিবিয়ানদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরাও ভোগ করতে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ২০-৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তার বিপরীতে মানুষের আয় বৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ, তিনগুণ। লিবিয়ান দিনারের মান কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে। গাদ্দাফির আমলের শেষের দিকে যেখানে ১ ডলার সমান ১.৩৫ দিনার ছিল, সেখানে ২০১২-১০১৩ সালে ১ ডলার = ১.২২ দিনার পর্যন্ত নেমে আসে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের তুলনায় একটু খারাপ হলেও পরিস্থিতি বুঝে একটু সাবধানে চলতে পারলে প্রায় স্বাধীনভাবেই সর্বত্র চলাফেরা করা যেত।
লিবিয়ার পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে ২০১৪ সালে, যখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ইসলামিস্ট বনাম ন্যাশনালিস্টদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং পরবর্তীতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে ত্রিপোলি এয়ারপোর্ট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়, লিবিয়ার আয়ের প্রধান উত্স তেল উত্পাদন বিপুল পরিমাণে হ্রাস পায় এবং বিশৃঙ্খলার সুযোগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের দখলে চলে যায়। দেশে একাধিক সরকার কার্যক্রম চালাতে থাকে, মিলিশিয়াদের দৌরাত্ম্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটে, প্রায় সবগুলো বিদেশী দূতাবাস লিবিয়ায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে মাল্টা এবং তিউনিসিয়ায় অবস্থান নেয়। অধিকাংশ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়, যেগুলো থেকে যায় সেগুলোও অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থার কারণে কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়।
২০১৪ এর গৃহযুদ্ধের পর এই দুই বছরে দিনে দিনে লিবিয়ার অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য লিবিয়ার অবস্থাকে মোটামুটি তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়।
১। অর্থনৈতিক সমস্যা
লিবিয়াতে এই মুহূর্তে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। লিবিয়ার অর্থনীতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। এখানে কর্মসংস্থানের সংকট প্রকট। বিদেশী কোম্পানি প্রায় নেই বললেই চলে। লোকাল কোম্পানিগুলোও অধিকাংশই ছয় মাস, এক বছর ধরে বেতন দিতে পারছে না। যারা বিভিন্ন দোকান-পাট, ফার্মেসী, পেট্রোল-পাম্প এবং বাসাবাড়িতে কাজ করছে, তারাই শুধু নগদ টাকা হাতে পাচ্ছে। কিন্তু সেই টাকা দেশে পাঠানোরও কোন উপায় নেই। কারণ মানিগ্রাম, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ সব ধরনের ট্রানজেকশন সার্ভিস দুই বছর ধরে বন্ধ। ফলে দেশে টাকা পাঠানোর একমাত্র উপায় হুন্ডি।
কিন্তু ব্ল্যাক মার্কেটে ১ ডলারের মূল্য গত দুই বছরে ১.৩০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬.৫০ দিনারে এসে পৌঁছেছে। অথচ মানুষের আয় তো বাড়েই নি, বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এই সময়ে তিন-চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অধিকাংশ অদক্ষ শ্রমিকের পক্ষে মাসে ৩০০ থেকে ৪০০ দিনারের বেশি সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে না, যা কোনোভাবে দেশে পাঠাতে পারলেও মাত্র ৬০ থেকে ৭০ ডলার হয়। আর এই টাকা পাঠানোও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। টাকা পাঠানোর নাম করে আত্মসাত্ করে আত্মগোপনের চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহই।
২। নিরাপত্তা পরিস্থিতি
বেনগাজি, সিরত, দারনাসহ লিবিয়ার বিভিন্ন অংশে আইএস এবং আল-কায়েদাপন্থী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালু থাকলেও প্রবাসী বাংলাদেশী অধিবাসীদের উপর সেগুলোর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই সাধারণত লিবিয়ানরা ঐসব এলাকা ত্যাগ করে, তাদের সাথে সাথে প্রবাসীরাও ঐসব এলাকা ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়। এতে তাদের চাকরি এবং কর্মসংস্থানে ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু নিরাপত্তাজনিত দিক থেকে খুব বড় কোন সমস্যা হয় না।
প্রবাসীরা বরং ঝুঁকির মুখে থাকে ত্রিপোলির মতো বড় বড় শহরগুলোতে, যেখানে বড় ধরনের কোন যুদ্ধ নেই, কিন্তু মিলিশিয়াদের দৌরাত্ম্য আছে। নিয়মিত পুলিশ এবং সেনাবাহিনী না থাকায় মিলিশিয়ারাই সর্বেসর্বা। কিন্তু পুরো দেশে মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সত্যিকার সংখ্যা কত, কে বৈধ, কে অবৈধ, সেটা জানার কোন উপায় নেই। সবার হাতে হাতে অস্ত্র, তাই যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় অস্ত্রধারী কোনো একটা গ্রুপ অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান ফিট করা দুই-তিনটা গাড়ি বসিয়ে চেকপয়েন্ট বসিয়ে দিতে পারে। এইসব চেক পয়েন্টে হয়রানির শিকার হওয়া বিদেশীদের জন্য নিয়মিত ব্যাপার।
আইনশৃঙ্খলা না থাকায় এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় অপরাধের মাত্রা লিবিয়ার ইতিহাসে এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ। শুধুমাত্র রাজধানী ত্রিপোলিতেই প্রতিদিন গড়ে ছয়টা থেকে সাতটা কিডন্যাপিংয়ের ঘটনা ঘটছে, যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশের শিকার বিভিন্নদেশী প্রবাসীরা। লিবিয়ানরা জানে, প্রবাসীরা দুই বছর ধরে দেশে টাকা পাঠাতে পারছে না, দুই বছরের সমস্ত উপার্জন তাদের ঘরেই আছে। কাজেই তাদেরকে কিডন্যাপ করলেই টাকা পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশীদেরকে কিডন্যাপ করার ক্ষেত্রে লিবিয়ান গ্যাংদের সাথে কিছু বাংলাদেশী দালালচক্রও জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিটা কিডন্যাপিংয়ের পর দুই-তিন হাজার দিনার, অথবা দেশে দেড়-দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়। টাকা দিতে দেরি হলেই চলে নির্যাতন।
কিডন্যাপিং এবং ছিনতাইয়ের ভয়ে রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মানুষকে ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। অপরিচিত ট্যাক্সিতে চড়া যায় না, অপরিচিত জায়গায় কাজে যাওয়া যায় না, অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়। ফলে যাদেরকে উপার্জনের জন্য বাইরে কাজের উপর নির্ভর করতে হয়, তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব জায়গায় কাজ করতে পারে না।
৩। ইউরোপযাত্রা সংক্রান্ত ঝুঁকি
লিবিয়াতে বাংলাদেশীদের আসার একটা বড় কারণ হচ্ছে ইতালিযাত্রা। কিন্তু দিনে দিনে এই যাত্রা আরো কঠিন হয়ে উঠছে। ইউরোপে যাওয়ার যতগুলো রুট আছে, তার মধ্যে লিবিয়া-টু-ইতালি হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ভূমধ্যসাগরে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে, যার অধিকাংশই লিবিয়া রুটের যাত্রী। শুধু মৃত্যুই না, যাত্রাপথে লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটলে তাদেরকে লিবিয়াতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তাদের স্থান হয় বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত ডিটেনশন সেন্টারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বারবার এসব ডিটেনশন সেন্টারের বন্দীদের মানবেতর জীবন যাপনের কাহিনী উঠে এসেছে।
সম্প্রতি সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইতালিতে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য ইতালির সাথে লিবিয়ান সরকারের একটা চুক্তির কথা আলোচিত হচ্ছে, যেই চুক্তির বলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইতালি লিবিয়ান সরকারকে অনুদান দিবে এসব অবৈধ অভিবাসীদেরকে লিবিয়াতেই ফেরত নিয়ে পুনর্বাসন করার জন্য। কিন্তু জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং গবেষকরা এই চুক্তির কঠোর সমালোচনা করছেন এই যুক্তিতে যে, এর ফলে এইসব অবৈধ অভিবাসীরা পুনর্বাসনের পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদে ডিটেনশন সেন্টারে আটকা পড়ে থাকবে। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে যেসকল বাংলাদেশী গত কয়েক বছরে অবৈধভাবে লিবিয়াতে প্রবেশ করেছে, তারাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
গত কয়েক মাসে লিবিয়ার পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় সাত মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সিরত আইএস মুক্ত হয়েছে। দুই বছরের যুদ্ধের পর বেনগাজিরও একটা বড় অংশ আইএস এবং আল-কায়েদাপন্থী গ্রুপগুলোর হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। অনেকগুলো তেলক্ষেত্র পুনরায় তেল উত্পাদন শুরু করেছে। কিন্তু সেগুলোর সুফল এখনও আসতে শুরু করেনি। অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতোই শোচনীয় আছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে লোক আসা নিষিদ্ধ হলেও দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে প্ররোচিত হয়ে অবৈধভাবে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশীরা লিবিয়াতে প্রবেশ করছে। কিন্তু এখানে আসার পর কাজ না পাওয়া, দেশে টাকা পাঠাতে না পারা, ছিনতাই-কিডন্যাপিঙয়ের শিকার হওয়া অনেকেই বিশাল ক্ষতিপূরণ দিয়ে আবার দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বাংলাদেশীদের উচিত হবে, লিবিয়ার পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত লিবিয়ার আসার ব্যাপারে আপাতত চেষ্টা না করা।