প্রত্যাবর্তন: হিশাম মাতার-এর পুলিৎজার জয়ী উপন্যাসের আংশিক অনুবাদ

২০১১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্তও আমি (হিশাম মাতার) ভাবতে পারিনি, জীবনে কখনও লিবিয়ায় ফিরে যেতে পারব।

সে সময় আমি সবেমাত্র লন্ডন ছেড়ে নিউইয়র্কে গিয়ে উঠেছিলাম। আমার বাবা-মা প্রথম এই শহরটিতে এসেছিলেন ১৯৭০ সালের বসন্তকালে, যখন আমার বাবাকে জাতিসংঘে লিবিয়া মিশনের প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। সেই শরৎকালেই আমার জন্ম।

তিন বছর পর, ১৯৭৩ সালে আমরা ত্রিপোলিতে ফিরে যাই। এরপরেও আমি চার কি পাঁচবার নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই সংক্ষিপ্ত সফরে। কাজেই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে যদিও আমি আমার জন্মস্থানেই গিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু এটি ছিল আমার কাছে প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি শহর।

১৯৭৯ সালে আমরা সপরিবারে আমাদের মাতৃভূমি লিবিয়া ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে গত তেত্রিশ বছরের জীবনে বেশ কিছু আশ্রয়দাতা শহরের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে: নাইরোবি, লিবিয়া থেকে পালিয়ে আমরা প্রথমে যে শহরটিতে উঠেছিলাম; কায়রো, পরবর্তী বছর আমরা যে শহরটিতে অনির্দিষ্টকালের নির্বাসিত জীবন শুরু করেছিলাম; রোম, যে শহরটি ছিল আমাদের ছুটি কাটানোর স্থান; লন্ডন, পড়াশোনার জন্য যেখানে আমি ১৫ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছিলাম এবং যেখানে পরবর্তী ২৬ বছর ধরে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে আসছিলাম; প্যারিস, লন্ডনের জীবনের প্রতি বিরক্ত এবং বিতৃষ্ণ হয়ে যেখানে আমি পাড়ি জমিয়েছিলাম ৩০ বছর বয়সে, কিন্তু নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে দুই বছর পরেই আবার যে শহরটি ছেড়ে লন্ডনে ফিরে গিয়েছিলাম।

এই শহরগুলোর প্রতিটিতে থাকার সময়ই আমি মাঝেমাঝে কল্পনা করতাম, একদিন আমি ফিরে গিয়ে শান্ত জীবন যাপন শুরু করব সুদূর ম্যানহাটনের সেই দ্বীপটিতে, যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল। আমি স্বপ্ন দেখতাম, আমার নতুন কোনো সঙ্গী হয়তো কোনো এক ডিনার পার্টিতে বা ক্যাফেতে, অথবা দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটার পর চেঞ্জিং রুমে বসে আমাকে সেই পুরাতন, ক্লান্তিকর প্রশ্নটি করছে, “তোমার দেশ কোথায়?”

আর আমি কোনো উৎকণ্ঠা ছাড়া, দ্বিধাহীন কণ্ঠে উত্তর দিচ্ছি, “নিউইয়র্ক”। এই কল্পনার জগতে আমি এটা ভেবেই আনন্দ পেতাম যে, আমার এই উত্তরটি একইসাথে সত্য এবং মিথ্যা, দুটোই হতে পারে, অনেকটা ম্যাজিক ট্রিকের মতো।

কিন্তু ২০১১ সালে ঠিক যখন লিবিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, সে সময় আমার চল্লিশতম বছর বয়সে আমি সত্যি সত্যিই ম্যানহাটনে গিয়ে বসবাস শুরু করি। এবং আমার ম্যানহাটনে পদার্পণের দিনটি ছিল ঠিক ১লা সেপ্টেম্বর,, ১৯৬৯ সালের যে দিনটিতে মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফি নামের এক তরুণ ক্যাপ্টেন রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন এবং তার মধ্য দিয়ে আমার জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। যেমন আমি কোথায় বেড়ে উঠব, কোন ভাষায় লেখালেখি করব, এমনকি এই বইটিও কোন ভাষায় লিখব। এর সবকিছুই কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশ ছাড়া শুধু দৈবক্রমে ঘটেছে – এটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়।

*** *** ***

লিবিয়ার যেকোনো রাজনৈতিক ইতিহাসে আশির দশকের সময়টুকু একটি বিশেষ ভীতিকর অধ্যায় দখল করে থাকে। সে সময় উন্মুক্ত চত্বরে এবং খেলার মাঠে সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বীদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হতো। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে বিদেশেও তাড়া করা হতো। কাউকে অপহরণ করা হতো, কাউকে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করা হতো।

অন্যদিকে এই আশির দশকেই লিবিয়াতে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। আর আমার বাবা ছিলেন এই বিরোধী দলগুলোর সবচেয়ে বিখ্যাত নেতাদের মধ্যে একজন।

বাবা যে সংগঠনটির সদস্য ছিলেন, তাদের লিবিয়ার ভেতরে কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড সেল এবং লিবিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের বাইরে চাদের মাটিতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। বাবার সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার, কূটনীতিক হিসেবে তার স্বল্পকালীন চাকরি জীবন, এবং সত্তরের দশকে যেভাবে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন, মিতসুবিশি গাড়ি থেকে শুরু করে কনভার্স স্পোর্টস শ্যু পর্যন্ত নানাবিধ পণ্য বাইরে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমদানি করছিলেন, তা তাকে সরকারের একজন বিপজ্জনক শত্রুতে পরিণত করেছিল।

স্বৈর সরকার প্রথমে বাবাকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলতে চেয়েছিল। সেটা ব্যর্থ হওয়ায় তারা তাকে ভয় দেখাতে শুরু করেছিল। আমার মনে আছে, আমার বয়স যখন দশ বা এগারো বছর, তখন এক বিকেলে আমাদের কায়রোর ফ্ল্যাটে আমি বাবার পাশে বসেছিলাম। বাবার ভারী হাতটা রাখা ছিল আমার কাঁধের ওপর।

আমাদের সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন সেই লোকগুলোর একজন, যাদেরকে আমি ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকতাম এবং যারা ছিলেন হয় বাবার সঙ্গী, অথবা অনুসারী। আমার মনে আছে, লোকটি বাবাকে ‘কম্প্রোমাইজ’ জাতীয় কিছু একটা বলেছিল। কিন্তু বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি সমঝোতায় বসব না। ক্রিমিনালদের সাথে তো না-ই।”

যখনই আমরা ইউরোপে যেতাম, বাবা তার সাথে একটি পিস্তল রাখতেন। গাড়িতে চড়ার আগে তিনি আমাদেরকে দূরে গিয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিতেন। তারপর নিজে কাছে গিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিতেন, জানালার কাছে মুখ নিয়ে দুই হাত দিয়ে চোখের দুই পাশ ঢেকে সাবধানে উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করতেন কোথাও বোমা রাখা আছে কি না। বাবার মতো লোকদেরকে সে সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ট্রেন স্টেশনে, ক্যাফেতে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল, তাদের গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল।

আশির দশকে যখন আমি কায়রোতে ছিলাম, তখন একবার সংবাদপত্রে এক সুপরিচিত লিবিয়ান অর্থনীতিবিদের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি যখন রোমের স্তাজিওন তারমিনি ট্রেন স্টেশনে একটি ট্রেন থেকে নেমে আসছিলেন, তখন এক আগন্তুক এসে তার বুকে পিস্তল চেপে ধরে এবং ট্রিগার টেনে দেয়।

পত্রিকায় প্রতিবেদনটির পাশে তার একটি ছবি ছাপানো হয়েছিল। সেখানে রাস্তায় পড়ে থাকা তার লাশটি ঢাকা ছিল সেদিনের পত্রিকার কয়েকটি পাতা দিয়ে, যেগুলো তার গোড়ালির কাছে গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার পালিশ করা চকচকে জুতোজোড়া তখনও উপরের দিকে খাড়া হয়ে ছিল।

আরেকবার পত্রিকায় এসেছিল গ্রীসে এক লিবিয়ান ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ। সে বসে ছিল এথেন্সের মোনাস্তিরাকি স্কয়ারের একটি ক্যাফের সামনের চত্বরে। হঠাৎ একটি স্কুটার এসে তার সামনে থামে এবং ড্রাইভিং সিটের পেছনে বসে থাকা লোকটি তার দিকে পিস্তল তাক করে পরপর কয়েকটি গুলি করে চলে যায়। একইভাবে লন্ডনে হত্যা করা হয় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক লিবিয়ান সংবাদ পাঠককে।

আর ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে লন্ডনের সেন্ট জেমস স্কয়ারে লিবিয়ান দূতাবাসের সামনে যখন একটি মিছিল শুরু হয়, তখন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা দোতলার একটি জানালা দিয়ে মেশিনগান বের করে এবং ভিড় লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। গুলিতে পুলিশ কর্মকর্তা ইভোন ফ্লেচার নিহত হন এবং এগারো জন লিবিয়ান প্রতিবাদকারী আহত হয়, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা ছিল গুরুতর।

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

আমার নতুন বই!!!

স্পাই স্টোরিজ ২: স্নায়ুযুদ্ধের সফলতম ডাবল এজেন্টের কাহিনি

অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে ননফিকশন স্পাই থ্রিলার। উচ্চপদস্থ এক ডাবল এজেন্টের কাছে ১৫ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনি।

৪০০ .০০

বইমেলায় থাকছে ৪৩৯ নম্বর (সতীর্থ প্রকাশনার) স্টলে। এছাড়াও পাবেন রকমারি ডট কমে (৩৫% ছাড়ে), প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ (৩৫% ছাড়ে) এবং আপনার পছন্দের যেকোনো অনলাইন বুকশপে।

বিস্তারিত
Short PDF

বিদেশে নির্বাসিত সমালোচকদেরকে খুঁজে বের করে হত্যা করার গাদ্দাফির যে অভিযানটি শুরু হয়েছিল আশির দশকের শুরুর দিকে লিবিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মুসা কুসার এক প্রকাশ্য জনসভায় দেওয়া ঘোষণার মধ্য দিয়ে, তা বিস্তৃত হয়েছিল ভিন্ন মতাবলম্বীদের পরিবার পর্যন্ত।

আমার একমাত্র সহোদর জিয়াদ তার ১৫ বছর বয়সের সময় সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিল সেখানকার একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই, সেমিস্টারের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ সে কায়রোতে ফিরে আসে।

আমরা সবাই মিলে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম তাকে গ্রহণ করতে। অ্যারাইভাল লাউঞ্জের ভিড়ের মধ্য থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা মানুষের ঢলের মধ্যে যখন তাকে দেখা যায়, তখন তার চেহারা এতো বেশি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, যা আমি এখন কল্পনাও করতে পারি না। এর কিছুদিন আগে আমি আমার মা’কে কয়েক জায়গায় টেলিফোন করতে দেখেছিলাম। যখন তিনি ডায়াল ঘোরাচ্ছিলেন, তখন তার আঙ্গুলগুলো কাঁপছিল এবং তার চেহারাও ছিল ফ্যাকাশে।

জিয়াদের সুইস স্কুলটি ছিল লোকালয় থেকে বহু দূরে, আল্পস পর্বতের উপরে। গণপরিবহনে করে সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রামে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল একটি ক্যাবল কার, যেটি দিনের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা চালু থাকত। দুই দিন ধরে জিয়াদ লক্ষ্য করছিল, তার স্কুলের প্রধান ফটকের বাইরে রাস্তার ধারে সারাক্ষণ একটি গাড়ি পার্ক করা ছিল। গাড়িটিতে চারজন লোক ছিল, যাদের প্রত্যেকের চুল ছিল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা, যা গাদ্দাফির রেভোল্যুশনারি কমিটির সদস্যের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যেত।

একদিন গভীর রাতে স্কুলের অফিস-টেলিফোনে জিয়াদের ডাক পড়ল। ফোনের অপর প্রান্তের লোকটি বলল, “আমি তোমার বাবার একজন বন্ধু। আমি যা বলব, তোমাকে ঠিক সেটাই করতে হবে। তোমাকে এখনই স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে এবং প্রথম ট্রেনটা ধরে ব্যাসল শহরে চলে যেতে হবে।”

“কেন? কী হয়েছে?” জিয়াদ জানতে চাইল।

“সেটা আমি এখন বলতে পারব না। তুমি তাড়াতাড়ি কর। স্টেশনে গিয়ে ব্যাসলগামী প্রথম ট্রেনটা ধর। আমি সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করব এবং তোমাকে সবকিছু খুলে বলব।”

“কিন্তু এখন তো মাঝ রাত!” জিয়াদ বলল।

লোকটি এর কোনো ব্যাখ্যা দিলো না। সে শুধু একই কথা বারবার বলে যেতে লাগলো, ” তোমাকে এখনই ব্যাসলে যাওয়ার প্রথম ট্রেনটা ধরতে হবে।”

“আমি সেটা করতে পারব না,” জিয়াদ বলল, “আমি আপনাকে চিনি না। প্লিজ আপনি এখানে আর কল করবেন না।” এইটুকু বলে জিয়াদ ফোন রেখে দিলো।

লোকটি এরপর মা’কে ফোন করল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মা স্কুলে ফোন করলেন। তিনি লোকটির কথা পুনরাবৃত্তি করে জিয়াদকে বললেন, তাকে তখনই স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হবে। কীভাবে কী করতে হবে, তিনি তাকে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে দিলেন।

সেই রাতের বেলা জিয়াদ তার প্রিয় শিক্ষককে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তিনি ছিলেন কেমব্রিজ থেকে পাশ করা অল্প বয়সী একজন শিক্ষক, যিনি হয়তো ভেবেছিলেন আল্পস পর্বতে গিয়ে সাহিত্য পড়ানোটা বেশ মজার একটা ব্যাপার হবে, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে স্কিইং করা যাবে।

জিয়াদ তাকে ডেকে তুলে বলল, “স্যার, আমার বাবার একটা অপারেশন হবে। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে তিনি আমাকে একবার দেখতে চাইছেন। আমাকে ব্যাসলগামী প্রথম ট্রেনটা ধরতে হবে। আপনি কি আমাকে একটু স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারবেন?”

জিয়াদের শিক্ষক মা’কে ফোন করলেন। মাও জিয়াদের গল্পটা সমর্থন করলেন। এরপর প্রধান শিক্ষককে জাগিয়ে তোলা হলো। তিনিও মা’র সাথে ফোনে কথা বললেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে অনুমতি দেওয়ার পর জিয়াদের শিক্ষক ট্রেনের সময়সূচী চেক করে জানতে পারলেন, মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যেই একটি ট্রেন ব্যাসলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। তাড়াতাড়ি করলে হয়তো তখনও ট্রেনটা ধরা যাবে।

স্কুল থেকে বের হওয়ার অন্য কোনো রাস্তা ছিল না। জিয়াদদের গাড়িটাকে তাই অনুসরণকারী গাড়িটার পাশ দিয়েই যেতে হলো। ঠিক যখন তাদের গাড়ি লোকগুলোর পাশে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জিয়াদ নিচু হয়ে জুতার ফিতা বাঁধার ভান করতে শুরু করল।

জিয়াদের শিক্ষক পর্বতের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কয়েক মিনিট পরেই তাদের পেছনে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। জিয়াদের শিক্ষক বললেন, “আমার মনে হচ্ছে ওরা আমাদেরকে অনুসরণ করছে।” জিয়াদ ভান করল, সে তার কথা শুনতে পায়নি।

স্টেশনে নেমে জিয়াদ এক দৌড়ে যাত্রীদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে পাবলিক টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। টয়লেটে বসেই সে শুনতে পেল, ট্রেন এসে থামছে। ট্রেন পুরোপুরি থামা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল। এরপর মনে মনে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় গুনল নতুন যাত্রীদেরকে ট্রেনে ওঠার সময় করে দেওয়ার জন্য। তারপর এক দৌড় দিয়ে লাফিয়ে ট্রেনে উঠে বসল।

দরজা বন্ধ হয়ে ট্রেন যখন চলতে শুরু করল, তখন জিয়াদ নিশ্চিত ছিল সে অনুসরণকারীদেরকে পেছনে ফেলে আসতে পেরেছে। কিন্তু তখনই ঐ চারজন লোককে সে আবার দেখতে পেল। তারা দুই সারি সিটের মাঝখান দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের একজন তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। লোকগুলো এক কামরা থেকে অন্য কামরা পর্যন্ত তার পিছু পিছু আসছিল আর বলছিল, “ছোকড়া, তুমি নিজেকে পুরুষ মনে কর? তাহলে এদিকে আস, আমাদেরকে দেখাও।”

ট্রেনের সামনের কামরায় গিয়ে জিয়াদ কন্ডাকটরকে ড্রাইভারের সাথে গল্পরত অবস্থায় দেখতে পেল। সে তাকে গিয়ে বলল, “ঐ লোকগুলো আমাকে অনুসরণ করছে।” জিয়াদের গলার স্বরে তীব্র আতঙ্ক প্রকাশ পাচ্ছিল। ফলে কন্ডাকটর সাথে সাথেই তার কথা বিশ্বাস করল এবং তাকে নিজের পাশে বসতে দিল।

লোকগুলো এটা দেখে পেছনের কামরায় ফিরে গেল। ট্রেন যখন ব্যাসল শহরে গিয়ে পৌঁছল, তখন জিয়াদ দেখতে পেল, প্লাটফর্মে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অপেক্ষা করছে। আর বাবার সহকারী যে লোকটি সে রাতে স্কুলে জিয়াদকে ফোন করেছিলেন, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশের সাথে।

*** *** ***

আমার সবগুলো বই


মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ ২ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার গল্পগুলো সিরিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদ

এর কিছুদিন পর, আমার বয়স যখন বারো বছর, তখন আমাকে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয়েছিল। মা আমাকে একটি প্লেনে তুলে দিয়েছিলেন। আমি কায়রো থেকে একা জেনেভা পর্যন্ত গিয়েছিলাম, যেখানে বাবার আমার জন্য অপেক্ষা করার কথা ছিল। এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল।

বাবা বলেছিলেন, “যদি কোনো কারণে তুমি আমাকে অ্যারাইভালে খুঁজে না পাও, তাহলে ইনফরমেশন ডেস্কে গিয়ে তাদেরকে বলবে আমার নাম ধরে ডাকার জন্য।” এরপর তিনি তার ছদ্ম নামগুলোর একটি বললেন, যেটি তিনি ভ্রমণের সময় ব্যবহার করতেন। “যেটাই কর, ভুলেও তাদেরকে আমার আসল নাম বলে দিও না।” তিনি আবারও বললেন।

জেনেভায় নেমে আমি বাবাকে খুঁজে পেলাম না। তার কথা মতো আমি ইনফরমেশন ডেস্কে গেলাম। কিন্তু যখন কাউন্টারের পেছনে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমার নামটা মনে পড়ল না।

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে ভদ্রমহিলা হাসলেন এবং মাইক্রোফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি কি নিজেই ঘোষণাটা দিতে চাও?” আমি মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকবার “বাবা, বাবা” বলে ডাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম, বাবা হাসিমুখে আমার দিকে ছুটে আসছেন।

আমার লজ্জা লাগছিল। আমার মনে আছে, এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন আমি তোমার আসল নাম বলতে পারি না? তোমার এত ভয় কীসের?”

আমরা ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম। আর ঠিক এমন সময়ই আমরা পাশে দাঁড়ানো দুজন লোককে দেখতে পেলাম, যারা নিখুঁত লিবিয়ান উচ্চারণে আরবিতে কথা বলছিল।

তাদের একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করছিল, “আচ্ছা, এই জাবাল্লাহ মাতার লোকটা দেখতে ঠিক কীরকম?” আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। এরপর থেকে আমি আর কখনও বাবার ভ্রমণকালীন জটিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কোনো অনুযোগ করিনি।

*** *** ***

বাবার জন্য নিজের আসল পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করা ছিল প্রশ্নাতীত ব্যাপার। তিনি সব সময়ই ছদ্মনাম এবং জাল কাগজপত্র ব্যবহার করতেন। শুধুমাত্র মিসরে আমরা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করতাম।

কিন্তু ১৯৯০ সালের মার্চে, মিসরীয় সিক্রেট পুলিশ বাবাকে আমাদের কায়রোর ফ্ল্যাট থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং গাদ্দাফির হাতে তুলে দেয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ত্রিপোলির আবু সেলিম কারাগারে, যেটার পরিচিতি ছিল “দ্য লাস্ট স্টপ” হিসেবে। সেখানে প্রশাসন তাদেরকেই পাঠাত, যাদেরকে তারা ভুলে যেতে চায়।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকজন লোক তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাবার লেখা তিনটা চিঠি আমাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। সেগুলোর একটাতে বাবা লিখেছিলেন, “বাস্তিল দুর্গের কারাগার সম্পর্কে আমরা যা কিছু পড়েছি, এই স্থানের নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। এখানে সবকিছুই কঠোর, কিন্তু তাদের উৎপীড়নের কৌশলের তুলনায় আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করি … কীভাবে মাথা নত করতে হয়, সেটা আমি জানি না।”

অন্য একটা চিঠিতে লেখা ছিল, “মাঝে মাঝে পুরো বছর পেরিয়ে যায়, যখন আমি একবারও সূর্যের দেখা পাই না, বা সেল থেকে বের হতে পারি না।”

স্থির, নিখুঁত এবং কখনও কখনও শ্লেষাত্মক গদ্যের বর্ণনায় তিনি তার আশ্চর্যজনক ধৈর্যের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন:

“এখন এই মহৎ প্রসাদের একটু বর্ণনা দেই … আমার কুঠুরিটা কনক্রিটের একটা বক্স। এর দেয়ালগুলো প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড স্ল্যাবের তৈরি। একটা স্টিলের দরজা আছে, যেখান দিয়ে কোনো বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। একটা জানালা আছে, যেটা মাটি থেকে সাড়ে তিন মিটার উঁচুতে। আর আসবাবপত্র যা আছে, তা ষোড়শ লুইয়ের সময়ের মতো: পুরনো একটা ম্যাট্রেস, পূর্ববর্তী বন্দীদের ব্যবহারে জীর্ণশীর্ণ, কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। এ এক অসীম শূন্যতা।”

এই চিঠিগুলো থেকে এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও সুইস এনজিও সংস্থা ট্রায়ালের সহায়তায় জোগাড় করা বন্দীদের সাক্ষ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম, বাবা অন্তত ১৯৯০ সালের মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আবু সেলিমে ছিলেন। এরপরে তাকে তার সেল থেকে সরিয়ে হয়তো একই জেলের অন্য কোনো সিক্রেট উইংয়ে অথবা ভিন্ন কোনো জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অথবা মেরে ফেলা হয়েছিল।

*** *** ***

হিশাম মাতারের আরেকটি উপন্যাস “অ্যানাটমি অফ এ ডিস্যাপিয়ারেন্স” নিয়ে আমার রিভিউ পড়ুন এখান থেকে

২০১১ সালের আগস্টের শেষদিকে ত্রিপোলির পতন ঘটে এবং বিপ্লবীরা আবু সেলিমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা সেলগুলোর দরজা ভেঙ্গে ফেলে এবং অবশেষে সেই কনক্রিটের বক্সগুলোর ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা বন্দীরা বাইরে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়।

সে সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। সেদিন আমার পুরোটা দিন কাটল ফোনে কথা বলে। আমার সাথে ফোনের অপর প্রান্তে ছিল সেই লোকগুলোর একজন, যারা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জেলের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল।

একটু পরপর সে চিৎকার করে উঠছিল, “থাম, থাম।” এবং তার পরপরই আমি লোহার দরজার উপর তার হাতুড়ি আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সাথে সাথে অসংখ্য মানুষ একসাথে চিৎকার করে উঠছিল, “আল্লাহু আকবার!”

সে তার হাতুড়িটা অন্য একজনের হাতে দিলো। ফোনের এপারে বসে আমি তার হাঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল বিজয়ের প্রতিধ্বনি।

তারা মাটির নিচে থাকা সর্বশেষ কুঠুরিটার সামনে পৌঁছল। প্রচণ্ড শোরগোল শোনা যাচ্ছিল, অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছিল। আমি শুনতে পেলাম লোকটা বলছে, “কী? ভেতরে? …” তাকে বিভ্রান্ত মনে হলো। তারপর সে আবার চিৎকার করে কাউকে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত?”

সে ফোনটা মুখের কাছে ধরে আমাকে জানাল, সবার ধারণা এই নির্জন প্রকোষ্ঠটিতে গুরুত্বপূর্ণ একজন বন্দী বহু বছর ধরে আটক আছে, যার বাড়ি আমার বাবার বাড়ির মতোই আজদাবিয়ায়। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, যদি আমি সেখানে থাকতে পারতাম!

“লাইনে থাক,” লোকটি বলল আমাকে। কয়েক সেকেন্ড পরপর সে একই কথা বলছিল, “আমার সাথে থাক।” এরপর দশ মিনিট লেগেছিল, নাকি এক ঘণ্টা, আমার মনে নেই। শেষপর্যন্ত যখন তারা দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল, তারা দেখতে পেল, জানালাবিহীন কক্ষটির ভেতরে এক অন্ধ বৃদ্ধ বসে আছেন।

তার শরীরের চামড়ায় বহু বছর ধরে সূর্যের আলো পড়েনি। যখন তারা তার নাম জিজ্ঞেস করল, বৃদ্ধ লোকটি উত্তর দিলেন, তিনি জানেন না। কোন পরিবারের সন্তান তিনি? তিনি জানেন না। কয় বছর ধরে তিনি সেখানে আছেন? তিনি জানেন না। বোঝা গেল, তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

উদ্ধারকারীরা কুঠুরির ভেতর বৃদ্ধ লোকটির একমাত্র সম্পত্তি খুঁজে পেল: আমার বাবার একটা ছবি। কেন? তিনি আমার বাবার কে হন? তার কাছে কোনো উত্তর ছিল না। যদিও তিনি কিছুই মনে করতে পারছিলেন না, কিন্তু মুক্ত হতে পেরে তিনি খুশি হয়েছিলেন। ফোনের অপর প্রান্তের লোকটা আমাকে সেরকমই জানিয়েছিল।

আমি ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। ছবিটা কি নতুন, না পুরাতন? সেটা কি দেয়ালে সাঁটানো ছিল, বালিশের নিচে রাখা ছিল, নাকি তারা সেটা খুঁজে পেয়েছিল বৃদ্ধ লোকটির বিছানার পাশে মেঝেতে পড়া অবস্থায়? সেখানে কি আসলে কোনো বিছানা ছিল? বন্দীদেরকে কি বিছানা দেওয়া হতো?

আমি এসব প্রশ্নের কোনোটাই জিজ্ঞেস করলাম না। যখন ফোনের অপর প্রান্তের লোকটি বলল, “আমি দুঃখিত”, আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।

— ব্রিটিশ-লিবিয়ান ঔপন্যাসিক হিশাম মাতারের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস The Return এর প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ। উপন্যাসটি ২০১৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। তার বাবা জাবাল্লাহ মাতারকে শেষপর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ১৯৯৬ সালে আবু সেলিম কারাগারে ১২৭০ বন্দীর উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেখানেই তিনি মারা গিয়েছিলেন।

আমার অনুবাদ যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে সবগুলো অনুবাদ পড়তে পারেন এই পাতা থেকে:

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

2 Comments

  1. অসাধারন লেখা। আপনার এই ওয়েবসাইটে যখন ঢুকি। এতই যে ভাল লাগে কোথা থেকে সময় শেষ হয়ে যায় টের ও পাইনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *