
লিবিয়ার প্রক্সিযুদ্ধের মূল্য দিচ্ছে বাংলাদেশীসহ প্রবাসী শ্রমিক এবং শরণার্থীরা: প্রথম আলোতে প্রকাশিত
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। রাজধানী ত্রিপোলির নিয়ন্ত্রণের জন্য এ বছরের এপ্রিলের ৪ তারিখে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ শুরু থেকেই ছিল মূলত আন্তর্জাতিক প্রক্সিযুদ্ধ বা ছায়াযুদ্ধ। গত সাড়ে সাত মাসে এর আন্তর্জাতিক রূপটি কেবল আরো প্রকট হয়েছে; অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্য দিয়েও, নিহত বেসামরিক জনগণের মধ্য দিয়েও।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে অন্তত নয়টি দেশ। একদিকে পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের সেনাপ্রধান, ফিল্ড মার্শাল খালিফা হাফতারকে সাহায্য করছে প্রধানত আরব আমিরাত, কিন্তু তার সাথে আরো আছে মিসর, সৌদি আরব, ফ্রান্স, সুদান, জর্ডান এবং রাশিয়া। অন্যদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার জিএনএর (গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড) পক্ষে আছে প্রধানত তুরস্ক, এবং সেই সাথে সীমিত আকারে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে কাতার। আর এসব দেশের অর্থায়নে এবং এদের দেওয়া অস্ত্রের এলোপাথাড়ি গোলাগুলি এবং বিমান হামলায় নিহত হচ্ছে দুই পক্ষের লিবিয়ান যোদ্ধাদের পাশাপাশি প্রায় এক ডজন দেশের নাগরিকরা।
বিদেশীদের হস্তক্ষেপের ফলে লিবিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেবে গত সাড়ে সাত মাসের লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে অন্তত ১,১০০ মানুষ। আহত হয়েছে আরো প্রায় ৬,০০০ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন বেসামরিক জনতা, পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী যাদের একটা বড় অংশই বিদেশী। আর ত্রিপোলিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা অন্তত ১০ জন।
বিদেশীদের উপর আক্রমণের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৮ নভেম্বর, সোমবার। ত্রিপোলির অদূরে ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি “ওয়াদি রাবিয়া” নামক এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের কয়েকশো শ্রমিক চাকরি করত। সেদিন সকালে প্রথমে ফ্যাক্টরির পাশেই অবস্থিত একটি সামরিক স্থাপনার উপর ড্রোন হামলা চালানো হয়। আতঙ্কিত শ্রমিকরা যখন ছুটোছুটি করতে শুরু করে, তখন তাদের উপরেও একের পর এক মিসাইল এসে পড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, তারা যখন বাঁচার জন্য দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল, তখন মূল ঘটনাস্থাল থেকে বেশ কিছু দূরে চলে যাওয়ার পরেও ড্রোনগুলো তাদেরকে অনুসরণ করে তাদের উপর মিসাইল নিক্ষেপ করছিল।
সোমবারের এই হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ৭ জন, যাদের মধ্যে ১ জন বাংলাদেশী এবং আরো ৪ জন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। এছাড়াও আহত হয়েছে আরো ৩৫ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জনই বাংলাদেশী। দূতাবাসের সূত্র অনুযায়ী এদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে ত্রিপোলির একটি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
এই লেখাটি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে “লিবিয়ায় পশ্চিমাদের ছায়াযুদ্ধ ও বাংলাদেশিদের প্রাণ” শিরোনামে গত ২৪ নভেম্বর, ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলোর আন্তর্জাতিক মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর লেখাটা পড়তে পারেন এখান থেকে। এছাড়াও লিবিয়ার পরিস্থিতি, বিশেষ করে লিবিয়ায় অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবস্থা নিয়ে বণিক বার্তায় (নভেম্বর, ২০১৯) প্রকাশিত আমার একটি লেখা পড়তে পারেন এখান থেকে, আর বিডিনিউজ ২৪ ডট কমে (ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) প্রকাশিত একটি লেখা পড়তে পারেন এখান থেকে।
এর আগে গত ৩ জুলাই ঘটেছিল প্রবাসীদের উপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি। ঐ ঘটনায় ত্রিপোলির অদূরের “তাজুরা” নামক এলাকার একটি ডিটেনশন সেন্টার তথা অভিবাসী আটককেন্দ্রের উপর চালানো বিমান হামলায় ৬জন বাংলাদেশী নিহত এবং আরো ৭জন আহত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে দুজনের শরীর এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের লাশ চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়নি।
যুদ্ধটা লিবিয়ার হলেও বাংলাদেশীদের নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ঘটেছে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর চালানো বিমান কিংবা ড্রোন হামলায়। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী তাজুরার অভিবাসী আটককেন্দ্রটিতে হামলা চালিয়েছিল “একটি বিদেশী রাষ্ট্র”। যদিও নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু অধিকাংশ প্রতিবেদনেই এই হামলাটিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান হামলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সোমবারের ওয়াদি রাবিয়ার হামলাটির পরেও জিএনএ সরকারের পক্ষ থেকে আরব আমিরাতকে দায়ী করা হয়েছে।
এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সরকারের পক্ষের একটি বিমান হামলায়ও একজন বাংলাদেশী নিহত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত নিহত ১০জন বাংলাদেশীর মধ্যে ৭জনই যে বিমান হামলায় মারা গেছে, সেটাও মূলত লিবিয়ার এই প্রক্সি ড্রোনযুদ্ধের চরিত্রটাকেই তুলে ধরে। যুদ্ধ চলছে ত্রিপোলি শহরের কেন্দ্র থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুই-তিনটি ফ্রন্টলাইনে, কয়েক কিলোমিটারের সীমিত কিছু এলাকায়। কিন্তু জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এই ছোটো এলাকাতেই গত সাড়ে সাত মাসে ১,০০০টিরও বেশি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। এরমধ্যে হাফতারের পক্ষে আরব আমিরাত চালিয়েছে প্রায় ৮০০ হামলা এবং জিএনএ সরকারের পক্ষে তুরস্ক চালিয়েছে প্রায় ২৪০টি হামলা।

লিবিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলোর এই ছায়াযুদ্ধটি মূলত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া দেশটির দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধেরই বিলম্বিত ধারাবাহিকতা, কিন্তু এর মূল নিহিত আছে ২০১১ সালের গাদ্দাফিবিরোধী গৃহযুদ্ধে। জটিল এই প্রক্সিযুদ্ধের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যেতে পারে, কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে একদিকে এটা হচ্ছে মিসরের জেনারেল সিসি স্টাইলের পুরাতন সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী ফিল্ড মার্শাল হাফতারের সাথে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তির বা সংস্কারপন্থীদের লড়াই। অন্যদিকে একইসাথে এটা হচ্ছে কাতার এবং তুরস্ক সমর্থিত রাজনৈতিক ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে সৌদি এবং আমিরাত সমর্থিত নন-ইসলামিস্ট শক্তির লড়াই, যারা এই অঞ্চলে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ইসলাম উভয়ের বিস্তারকেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করে।
এর বাইরে ফ্রান্স, রাশিয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্র লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে, অথবা নিজেদের আঞ্চলিক মিত্রদের অনুরোধে। আমেরিকা ২০১২ সালের পর থেকে লিবিয়া থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের অবস্থান জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের প্রতি হলেও তাদের প্রধান দুই আঞ্চলিক মিত্র সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত যেহেতু হাফতারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তাই হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও আমেরিকাকে নীরব ভূমিকা পালন করতেই দেখা গেছে। ইয়েমেনের মতোই লিবিয়াতেও মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌন সমর্থনই আরব আমিরাতের জন্য বেপরোয়া বিমান হামলা চালিয়ে বেসামরিক জনগণকে হত্যার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
সহসা লিবিয়ার এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনে দিনে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠছে। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বর থেকে হাফতারের পক্ষে রাশিয়ান প্রাইভেট মিলিটারি বাহিনী ওয়াগনারের ২০০ সৈন্য যোগ দেওয়ার পর যুদ্ধটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইয়েমেনের মতোই লিবিয়ার এই যুদ্ধও গড়াতে পারে কয়েক বছর পর্যন্ত, বাড়তে পারে বেসামরিক জনগণের হতাহতের ঘটনা, নিশ্চিত হতে পারে লিবিয়ার চিরস্থায়ী ধ্বংস।
তবে এখনও পর্যন্ত লিবিয়ার এই যুদ্ধ ত্রিপোলির নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মধ্যেই সীমিত আছে। অধিকাংশসময়ই দেখা যায়, বিদেশে বাংলাদেশীদের এ ধরনের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে সেই দেশে বৈধভাবে মানুষের আসা-যাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু লিবিয়াতে এখনও সেরকম কিছু করার সময় আসেনি। ত্রিপোলির বাইরে লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে, এমনকি ত্রিপোলির ভেতরেও যুদ্ধের প্রভাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশীরা মোটামুটি ভালো আছে। তারা নিয়মিত রেমিট্যান্সও পাঠাতে পারছে।
বরং যেটা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, ফ্রন্টলাইনের আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে বাংলাদেশীদেরকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে, কিংবা সরে যেতে শ্রমিকদেরকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে সরকারের এবং দূতাবাসের আরো জোরালো ভূমিকা, এবং সেই সাথে অবৈধভাবে দুবাই কিংবা সুদান হয়ে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে লিবিয়াতে প্রবেশ বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ লিবিয়াতে যারা আগে থেকেই বসবাস করছে, তারা ইতালিতে না গেলেও নতুন করে যারা আসছে, তাদের অনেকেই ইতালিতে যাওয়ার জন্যই আসছে এবং সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে কিংবা বন্দী হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। এভাবে সমুদ্রপথে মৃত্যুর সংখ্যা যুদ্ধের কারণ মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

