গোস্ট রাইটার (Ghost Writer) বলে একটা শব্দ আছে। না, ভৌতিক গল্পের লেখক না। গোস্ট রাইটার অর্থ নেপথ্য লেখক। এ ধরনের লেখকরা টাকার বিনিময়ে অন্যের নামে লেখে। এটা শুধু বাংলাদেশে না, দুনিয়ার সব দেশেই আছে। আপনি যে বিল ক্লিনটনের মাই লাইফ বা হিলারি ক্লিনটনের হার্ড চয়েস পড়ে অনেক জ্ঞান আহরণ করেন, আপনার কি ধারণা ওগুলো তাদের নিজেদের লেখা? না, ওগুলো প্রফেশনাল গোস্ট রাইটারদেরই লেখা।
গল্পগুলো মূল লেখকদের নিজেদের জীবনের, কাহিনীগুলো তারাই বলেন, হয়তো খসড়াও তারাই করে দেন, কিন্তু সেটাকে আগাগোড়া সার্থক বই হিসেবে রূপান্তরের কাজটা, সেটাকে আকর্ষণীয় করে তোলার কাজটা, সেটার মধ্যে সাহিত্যের ভাষা ব্যবহার করার কাজটা গোস্ট রাইটাররাই করেন। কিন্তু বইগুলো পুরো দুনিয়াতে বেস্ট সেলার হলেও, কোনো পুরস্কার পেলেও তাদের নাম কোথাও আসে না।
তাহলে কেন তারা অন্যের নামে লেখেন? সহজ উত্তর, টাকার জন্য। কারণ তাদেরকে কেউ চেনে না। তারা যদি নিজেরা ক্লিনটনের নামে বই লেখেন, তাহলে হয়তো সেই বই বিক্রি হবে ২০০০ কপি। আর যদি নিজের নাম গোপন করে ক্লিনটনের সাথে চুক্তিতে গিয়ে ক্লিনটনের নামে বই লেখেন, তাহলে সেটা বিক্রি হবে ২ লাখ কপি। এককালীন বা পার্সেন্টেজ – যে হিসেবেই তারা চুক্তি করেন, তাদের কাছে দ্বিতীয়টা লাভজনক মনে হয় বলেই তারা সেটা করেন।
এখন এটা কি অন্যায়? হতে পারে। আইডিয়াল সংজ্ঞায় আপনি যেহেতু সত্য গোপন করছেন, কাজেই এটা অন্যায়। কিন্তু এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে। এবং সিস্টেমটা এভাবেই চলছে। সুতরাং এটাকে অন্যায় বললে আপনাকে সিস্টেমটার বিরুদ্ধেই কথা বলতে হবে। নির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে বললে সেটা তার প্রতি অবিচার করা হবে।
কখন এটা অন্যায় হবে? ধরেন ক্লিনটনের সাথে আপনার চুক্তি হলো আপনাকে গোস্ট রাইটিংয়ের বিনিময়ে বইয়ের ১৫% পার্সেন্ট রয়ালটি দেওয়া হবে। অথবা ধরেন এককালীন ১০ হাজার ডলার দেওয়া হবে। কিন্তু যেহেতু ক্লিনটন এখন আর প্রেসিডেন্ট না, টাকা-পয়সার টানাটানি, তাই উনি আপনাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ১০% রয়ালটি বা ৭ হাজার ডলার ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিলেন। এটা যদি হয়, তাহলে এটা পরিষ্কার জুলুম। আপনার পুরো অধিকার আছে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে মামলা করার।
কিন্তু যদি এরকম না হয়? ধরেন যদি আপনি নিজেই চুক্তি করার সময় মাত্র ৫% রয়ালটির বা নগদ ২ হাজার ডলারের চুক্তি করলেন? সেটা কি জুলুম? এখানে ব্যাপারটার মধ্যে আপনি ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে আসলে সমস্যা। কিন্তু যদি ফ্রি মার্কেটের সংজ্ঞায় যান, তাহলে এটাও জুলুম না, প্রতারণা না।
কেন? কারণ আপনাকে কেউ বাধ্য করছে না। ক্লিনটনই একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট না। ওবামাও আছে। সেও বই লিখবে। দুই দিন পরে ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় হলে সেও বই লিখবে। আপনার যদি নিজের লেখার উপর আত্মবিশ্বাস থাকে, আপনার লেখনী যদি ভালো হয়, তাহলে আপনাকে ক্লিনটনের সাথেই পড়ে থাকতে হবে কেন? আপনি চাইলে ওবামার সাথে ন্যায্য চুক্তিতে গিয়ে ২০% পার্সেন্ট রয়ালটি বা ২০ হাজার নগদ ডলারের বিনিময়েও লিখতে পারেন!
একই ব্যাপার গোস্ট রাইটের ক্ষেত্রে না শুধু, আসল লেখকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধরেন আমি বই লিখলাম। এখন নতুন লেখকরা বাজারে ৫% থেকে ১৫% পর্যন্ত রয়ালটি পায়। আমার যদি নিজের লেখার উপর আত্মবিশ্বাস না থাকে, আমি যদি “নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে” মনোভাব থেকে ৫% রয়ালটিতেই রাজি হয়ে যাই, দোষটা কার? আমার, না প্রকাশকের?
প্রকাশকের দোষটা কখন হবে? যখন সে আমার সাথে কোনো চুক্তিতেই আসতে না চাইবে। যখন আমার বই বিক্রি করবে ১ হাজার, কিন্তু বলবে মাত্র ২০০ কপি বিক্রি হয়েছে। এবং এরপর যে ৫% রয়ালটিই আমি পাওনা ছিলাম, সেটাও না দিয়ে ঘোরাবে। বিভিন্ন অজুহাত দেখাবে। সেটা অহরহ ঘটছে এবং সেটা নিশ্চিতভাবেই অন্যায়। কিন্তু আমি যে ৫% রয়ালটিতে রাজি হলাম, তার দায়টা সম্পূর্ণই আমার।
৫% তো তাও ভালো। কিছু কিছু লেখক যে নিজের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করে, তার দায়টা কার? হ্যাঁ এখানে নৈতিক দায়টা প্রকাশকের, যেহেতু সে টাকার লোভে মান যাচাই না করেই আলতু-ফালতু বই ছাপাচ্ছে। কিন্তু দুই দিন পরে কি ঐ লেখক এসে প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে যে, তাকে ঠকানো হয়েছে?
না। কারণ সে অবুঝ শিশু না। তাকে বই প্রকাশ করতেই হবে – এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। সে বুঝে-শুনেই নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করেছে।
বিভিন্ন বইয়ের রিভিউসহ বইপত্র সংক্রান্ত আমার সকল লেখা একত্রে পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।