
গাদ্দাফি এখনও বেঁচে আছেন – জনপ্রিয় থ্রিলার লেখকের ১৫টি পয়েন্ট
জেমস মরকান (James Morcan) একজন হরর, থ্রিলার, ক্রাইম বিষয়ক লেখক। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় না। তিনি একাধারে একজন চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক এবং চলচ্চিত্র প্রযোজকও। তার চলচ্চিত্রগুলোর কোনোটাই অবশ্য বিখ্যাত না, কিন্তু লেখক হিসেবে তার মোটামুটি ভালোই পরিচিতি আছে।
তার গুডরিডস অথর প্রোফাইলে মোট ২৯টা বইয়ের নাম পাওয়া যায়, ৪ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে যেগুলো গড়ে ৩.৯৯ রেটিং অর্জন করেছে। প্রোফাইলে থাকা বর্ণনা অনুযায়ী তার দুইটা বই নাকি বেস্ট সেলার, যেগুলো মোট আটটা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অবশ্য বেস্ট সেলার লিস্টগুলোতে যে বিভিন্ন ধরনের ধোঁকাবাজি সম্ভব, সেটা তো জানা কথা।
আরও পড়ুন: বেস্ট সেলার লিস্টের ভাঁওতাবাজি।
তো এই বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় লেখক বিশ্বাস করেন, মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফি আসলে মারা যাননি। যিনি মারা গিয়েছেন তিনি হয়তো গাদ্দাফির বডি ডাবল, অথবা পুরো ভিডিওটাই ফেক। আসল গাদ্দাফিকে হয়তো ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থা এমআইসিক্স উদ্ধার করে নিয়ে গেছে 🙂
তার বক্তব্যের পক্ষে তিনি অনেকগুলো যুক্তি (!) তুলে ধরেছেন। গুডরিডসেই একটা থ্রেড খুলে ১৫টি পয়েন্টে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। পয়েন্টগুলো অবশ্য তার নিজের আবিষ্কার না। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেছেন লিবিয়ান একটা কন্সপিরেসি ব্লগ থেকে।
না, তিনি শুধু ২০১১ সালে গাদ্দাফির মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর অল্প কিছুদিন এই ধারণা পোষণ করতেন, পরে ভুল বুঝতে পেরেছেন – ব্যাপারটা এরকম না। অন্তত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি নিশ্চিতভাবেই এই দাবিগুলো বিশ্বাস করতেন। এবং সম্ভবত এখনও করেন। কারণ তিনি পোস্টটা করেছিলেন ২০১৬ সালে। এবং সেই পোস্টের নিচে সর্বশেষ মন্তব্য করেছেন ২০১৯ সালের অক্টোবরে।
অ্যানিওয়ে, গাদ্দাফি কেন মারা যায়নি, সে সম্পর্কে তার পয়েন্টগুলো থেকে ইন্টারেস্টিং দুই-চারটা পয়েন্ট (সবগুলো পয়েন্ট এখানে আছে) উল্লেখ করি:
১। গাদ্দাফিকে ধরার ভিডিওতে পরিষ্কার সূর্য দেখা যাচ্ছিল, চারদিক খটখটে শুকনো ছিল। অথচ এর একদিন আগেই সিরতে বৃষ্টিতে সবকিছু ভেসে গিয়েছিল।
বলাই বাহুল্য, এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট একটা দাবি। আমরা সে সময় সিরতে ছিলাম। গাদ্দাফির মৃত্যুর অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে সিরতে কোনো বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি হয়েছিল আরো প্রায় দুই সপ্তাহ আগে, এবং তখন সত্যি সত্যিই সিরতের রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু যারা বিশ্বাস করতে চায়, তাদের জন্য এই মিথ্যা তথ্যের পক্ষেই “প্রমাণ” তুলে ধরা যাবে। ইন্টারনেটে এমন অনেক ছবি পাওয়া যাবে, যেগুলো হয়তো তোলা হয়েছিল আরো আগে, কিন্তু পোস্ট করা হয়েছিল গাদ্দাফির মৃত্যুর আগের দিন।
২। গাদ্দাফিকে নর্দমার পাইপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয়, সেটা মিথ্যা। কারণ ভিডিওতে তাকে ক্লিন শেভ করা অবস্থায় দেখা গেছে।
অধিকাংশ পয়েন্টের মতোই এটাও চূড়ান্ত হাস্যকর একটা পয়েন্ট। কারণ দুনিয়ার কেউ দাবি করেনি যে, গাদ্দাফি কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে নর্দমার পাইপে বাস করছিলেন। বরং তার সাথে থাকা ঘনিষ্ঠদের সাক্ষাৎকারে পরদিনই জানা যায়, শেষ দিনগুলোতে তিনি ডিসট্রিক্ট টুর বিভিন্ন বাসায় থাকতেন। কেবল সেদিন সকালে পালানোর সময় ন্যাটোর বোমা থেকে বাঁচার জন্যই তিনি সুয়েজ পাইপের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: গাদ্দাফির জীবনের শেষ দিনগুলো
৩। শুধু গাদ্দাফি না, গাদ্দাফির ছেলেরাও সেদিন সিরতে মারা গেছিল বলে দাবি করা হয়, অথচ সবাই জানে গাদ্দাফি এবং তার ছেলেরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। কাজেই এই দাবিটা মিথ্যা।
এটাও বানোয়াট একটা পয়েন্ট। গাদ্দাফির “ছেলেরা” সেদিন মারা গিয়েছিল বলে দাবি করা হয়নি। গাদ্দাফির এক ছেলে মৌতাসেম মারা গিয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল এবং সে আসলেই মারা গিয়েছিল। আর সে যে যুদ্ধের শুরু থেকেই সিরতে ছিল, সেটা সবাই জানত।
আশা করি ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। এখানে যেটা করা হয়েছে, সম্পূর্ণ বানোয়াট কিছু দাবি আবিষ্কার করে, সেগুলোকে ডিবাঙ্ক করা হয়েছে। এবং এমন অনেক দাবি তোলা হয়েছে, যেগুলো এর আগে কেউ তোলেনি। যেমন গাদ্দাফির নাকি ১২জন বডি ডাবল ছিল!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটা সিঙ্গেল দাবির পক্ষেও কোনো সোর্স হাজির করা হয়নি, কোনো লিঙ্ক দেওয়া হয়নি। জাস্ট ব্লগের মতো লিখে যাওয়া হয়েছে। তারপরেও এই “বিখ্যাত” থ্রিলার লেখক পর্যন্ত সেগুলো বিশ্বাস করে বসে আছেন!
এই জাতীয় পয়েন্টগুলোর মজা এটাই, কোনো বিষয় সম্পর্কে আগে থেকে কিছুটা বায়াস থাকলে, এবং সেই ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে এগুলো সহজেই বিশ্বাস করতে মনে চায়। মানুষ চাঁদে যায়নি থেকে শুরু করে অধিকাংশ কন্সপিরেসি থিওরিই এই টাইপের।
কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই ইন্টারনেট পণ্ডিতরা খাটের নিচে বসেই বিশাল বিশাল পোস্ট লিখে ফেলে – “এটা যদি এরকম হয়, তাহলে ওটা ওরকম কেন? তার মানে নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র”।
যেহেতু কোনো প্রমাণ দরকার হয় না, শুধু প্রচলিত ঘটনার বিবরণকে টুইস্ট করে কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে “বৃহত্তর কোনো শক্তির” উপরে দায় চাপিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়, তাই এই জাতীয় পোস্টের কখনোই কোনো অভাব হয় না। এবং এই লেখকের মতো অনেক জ্ঞানীগুণি মানুষও সেগুলো সহজেই বিশ্বাস করে।
যেহেতু গাদ্দাফির পশ্চিমাবিরোধী একটা জনপ্রিয় ইমেজ ছিল, তাই তার হত্যাকাণ্ডকে অধিকাংশ মানুষই মেনে নিতে পারে না। তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে তো বটেই, তাকে হত্যার দাবির মধ্যেও কন্সপিরেসি খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। আর সে কারণেই এ ধরনের গাঁজাখুরি দাবি দেখেও বিন্দুমাত্র বিচার-বিবেচনা না করে সেগুলো বিশ্বাস করে বসে।
এই থ্রিলার লেখক একা না, লিবিয়াতে আমাদের আশেপাশে শতশত লিবিয়ানকে দুই-তিন বছর পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে এ ধরনের কন্সপিরেসি থিওরিতে অটল থাকতে দেখেছি। তাদের বিশ্বাস ছিল, গাদ্দাফি মারা যাননি, তিনি কোথাও লুকিয়ে আছেন, সময় হলেই আত্মপ্রকাশ করবেন।
সিরতে লিবিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত এ ধরনের কন্সপিরেসি থিওরিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটা কাহিনী ছিল, গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার আগেই কোনো এক ধরনের ড্রাগ খেয়ে নিয়েছিলেন। ফলে ধরা পড়ার পর তাকে হত্যা করার আগে তিনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে যান। আর বিদ্রোহীরা তাকে মৃত ভেবে কবর দিয়ে ফেলে।
ঐ ড্রাগ নিলে বছরের পর বছর অজ্ঞান অবস্থায় বেঁচে থাকা যায়। এরপর নির্দিষ্ট একটা ইনজেকশন দিলেই জ্ঞান ফিরে আসে। ঐ ইনজেকশনের মূল্য ৪ মিলিয়ন ডলার। ঐ টাকা জোগাড় হলেই গাদ্দাফির আত্মীয়-স্বজনরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনবে!
২০১৪ সাল পর্যন্তও লিবিয়ানদেরকে এই গল্প বলতে দেখেছি। কিন্তু এরপর দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ, আইএসের উত্থান প্রভৃতির মাধ্যমে লিবিয়ার ধ্বংস নিশ্চিত হওয়ার পরেও গাদ্দাফির পুনরুত্থান না হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়ে। এবং ২০১৫ সালের পরে কোনো লিবিয়ানের মুখে এ ধরনের বক্তব্য আর শুনিনি। বরং গাদ্দাফি-ভক্তদের মধ্যেও এখন ব্যাপারটা এক ধরনের হাস্যরসের উপাদান।
এই থ্রিলার লেখক পরিষ্কারভাবেই তাদের চেয়েও বেশি ব্রেইন ওয়াশড 🙂


2 Comments
Muhammed
সালামআলাইকুম…কেমন আছেন, আপনার লেখাগুলো পড়ার পর থেকে কোথাও লিবিয়ার যুদ্ধের নিউজ দেখলেই আপনার কথা মনে হয়।
লিবিয়ায়ার বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিকে মোড নিচ্ছে সেটি নিয়ে লিখে পেলুন। অধীর অপেক্ষায় রইলাম। আর আপনার টুইটার আইডিটি দিবেন। ফেসবুক নাই।
Mozammel Hossain Toha
ধন্যবাদ। টুইটারে আসলে আমি সাইলেন্ট ইউজার। কোনো টুইট করি না। জাস্ট পড়ে যাই।