দেখলাম ইরানি পরিচালক আসগর ফরহাদি পরিচালিত মুভি A Hero (2021)।
আসগর ফরহাদির আমি হিউজ ফ্যান। যেই লোক মাত্র সাতটা (এখন নয়টা হয়েছে) মুভি বানিয়ে তিনবার অস্কারে যায় এবং দুইবার অস্কার পায়, তাও বয়স চল্লিশ পেরুনোর আগে, তার ফ্যান না হয়ে উপায় কী?
আসগর ফরহাদির সবগুলো মুভিই দেখে শেষ করেছি। ইনক্লুডিং সে ফেমাস হওয়ার আগেরগুলো। এবং আমার মতে, সে বিদেশের সেটিংয়ে না গিয়ে ইরানের পটভূমিতে সিনেমা বানালেই তার বেস্টটা দিতে পারে।
আসগর ফরহাদির প্রথম মুভি Dancing in the Dust শুধু একটু কম ভালো লেগেছে। কিন্তু এরপর থেকে তার প্রতিটা মুভিই দারুণ। কিন্তু পার্সিয়ানগুলো। মাঝখানে যে দুইটা বিদেশে বানিয়েছে – একটা ফ্রান্সে, আরেকটা স্পেনে, সেগুলো খুব একটা ভালো লাগেনি। বিশেষ করে Everybody Knows এর কথা বলা যায়। সেখানে পেনেলোপি ক্রুজ আর হ্যাভিয়ের বারদেমের মতো হেভি কাস্ট থাকা সত্ত্বেও মনের মধ্যে দাগ কাটতে পারেনি।
২০১৬ সালের The Salesman এর দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আসগর ফরহাদি আবার ফিরে গিয়েছেন তার চিরচেনা সেই স্টাইলে – মধ্যবিত্ত ইরানি সমাজের পটভূমিতে। অ্যাজ ইউজুয়াল, আসগর ফরহাদির এই মুভিতেও চরিত্রগুলো অত্যন্ত অনেস্ট। টিপিক্যাল ভালো বনাম খারাপের দ্বন্দ্ব এখানে নেই। এখানে আছে ভালো এবং ভালোর দ্বন্দ্ব।
এই ভালো চরিত্রগুলোই দুর্ভাগ্যক্রমে, অথবা ছোটখাটো কোনো ভুলের কারণে, অথবা রাগের মাথায় করে ফেলা কোনো অন্যায়ের কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়ে যায়। সেই সংকট থেকে যতই তারা বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে, ততই যেন সংকট তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেতে থাকে চরিত্রগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে থাকে সিনেমার কাহিনী।
এ হিরো মুভির কাহিনীও সেই একই চিরচেনা ফরম্যাটের। কিন্তু তারপরেও আসগর ফরহাদির জটিল ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের দক্ষতায় এই স্টাইলটা একটুও পুরানো হয়নি।
এ হিরো মুভির হিরো রহিম সুলতানি একজন অপরাধী, যে ব্যবসার জন্য তার এক্স ওয়াইফের বড় ভাইর কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পারার দায়ে জেল খাটছে। মাঝখানে একবার সে দুই দিনের প্যারোলে মুক্তি পায়। সে সময় তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেলে সে রহিমকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া এক ব্যাগ গোল্ড কয়েন দেয়।
রহিম প্রথমে সেগুলো বিক্রি করে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে, সেগুলোর টাকা দিয়েও ঋণ পুরোপুরি শোধ হবে না, এবং তার শাস্তি মওকুফ হবে না, তখন সে গোল্ড কয়েনগুলো মূল মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মূল মালিকের খোঁজে সে রাস্তায় রাস্তায় হাতে লেখা পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়ে আসে।
প্যারোল শেষ করে জেলে ফেরার পর যখন তার এই স্বর্ণমুদ্রা ফিরিয়ে দেওয়ার কাহিনী জানাজানি হয়, তখন জেল কর্তৃপক্ষ বেশ অভিভূত হয়। নিজে ঋণগ্রস্ত হওয়ার কারণে জেল খাটা সত্ত্বেও লোভ সংবরণ করে স্বর্ণ ফিরিয়ে দেওয়াটা সহজ কথা না। তারা মিডিয়ায় খবর দেয়। সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলোর কল্যাণে রহিম রীতিমতো লোকাল হিরোতে পরিণত হয়।
জেল কর্তৃপক্ষ এবং লোকাল কাউন্সিল রহিমের এক্স ওয়াইফের ভাই বাহরামকে অনুরোধ করতে থাকে, একটা চ্যারিটির উদ্যোগে ওঠা মানুষের সাহায্যের অল্প কিছু টাকা নিয়ে সে যেন রহিমের কেসটা তুলে নেয়। এরকম একজন মহান ব্যক্তি জেলে থাকা উচিত না।
আরও পড়ুন: আসগর ফরহাদির জীবনী এবং তার মুভি পরিচালনার স্টাইল। এছাড়াআমার লেখা সকল মুভি রিভিউ এবং মুভি বিষয়ক আলোচনা পড়ুন এখান থেকে।
এখানেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। কারণ রহিম বেসিক্যালি এমন একটা কাজ করেছে, যেটা প্রশংসনীয় ঠিকই, কিন্তু স্পেশাল কোনো ভালো কাজ না। সে মূলত স্বর্ণমুদ্রাগুলো ফেরত দিয়ে একটা মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। কিন্তু তাতে বাহরামের কী? এখন তাকে কেন নিজের পাওনা টাকার দাবি ছেড়ে দিতে হবে?
রহিম জাস্ট একটা দায়িত্ব পালন করেই সমাজের চোখে হিরো হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাহরাম নিজেও সারা জীবন কারো কোনো ক্ষতি করেনি, বরং রহিমের মতো মানুষদেরকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে নিজে বিপদে পড়েছে, কিন্তু তাকে তো কেউ হিরো বলেই নি, বরং এখন অযৌক্তিকভাবে রহিমের টাকা মাফ করে না দেওয়া সমাজের চোখে সে হয়ে যাচ্ছে ভিলেন!
কাজেই বাহরাম রহিমকে ক্ষমা করতে রাজি হয় না। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ একজন সন্দেহ প্রকাশ করে পোস্ট দেয়, রহিমের এই পুরো পরোপকারের ব্যাপারটাই হয়তো ফেক – নিজেদের ইমেজ পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রিজন কর্তৃপক্ষের সাজানো নাটক। হিরো থেকে ধীরে ধীরে রহিম নিজেই এবার ভিলেন হয়ে উঠতে থাকে সমাজের চোখে …
এ হিরোকে আমি আসগর ফরহাদির বেস্ট মুভি বলব না। আমার মতে তার বেস্ট কাজ এ সেপারেশন, এরপর অ্যাবাউট এলি, এরপর দ্য সেলসম্যান, তারপর এ হিরো। কিন্তু এদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। জটিল ড্রামা বিল্ড আপ আর ক্যারেক্টার অ্যানালাইসিসের জন্য এদের প্রতিটাই মাস্ট ওয়াচ। অ্যাবাউট এলি বাদে বাকি দুটো তো অস্কার পেয়েছেই, আশা করি এবারেরটাও অ্যাটলিস্ট নমিনেশন পাবে।