গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড কে?

বাঙালির একটা সমস্যা হলো, তারা সাধারণ মানুষের এজেন্সিতে বিশ্বাস করে না। যেকোনো বড় ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যায় তাদের সব সময় সুপারম্যান প্রয়োজন হয়, মাস্টারমাইন্ড প্রয়োজন হয়। বিদেশী ষড়যন্ত্র বা বিদেশী মাস্টার প্ল্যান প্রয়োজন হয়।

এই গণঅভ্যুত্থানকেও তাই অনেকে সাধারণ মানুষের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে বিশ্বাস করতে রাজি না। অনেকেই তাই এর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা, ফরহাদ মজহারের ভূমিকা, জামাত-শিবিরের মাস্টার প্ল্যান ইত্যাদি খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই ধারারই একটা উপধারা হলো মাহফুজ আব্দুল্লাহকে এই গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে গ্রহণ করা।

ব্যাপারটা সম্ভবত শুরু হয়েছিল শফিকুল আলম ভাইয়ের একটা স্ট্যাটাস থেকে। উনিই সর্বপ্রথম মাহফুজ আব্দুল্লাহকে এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনের ব্রেইন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে আন্দোলন চলাকালীন বাংলা ট্রিবিউনের একটা রিপোর্ট, যেখানে তাকে “ইন্টেলেকচুয়াল তরুণ” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছিল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটা গণঅভ্যুত্থানে মাস্টার মাইন্ডের কৃতিত্ব আসলে কতখানি?

সন্দেহ নাই, মাহফুজ আব্দুল্লাহ ব্রিলিয়ান্ট। সে এতই ব্রিলিয়ান্ট, তার অনেকগুলো লেখা আমার বুঝতে কষ্ট হয়। এবং রিপোর্টে যেহেতু এসেছে, শফিকুল আলম ভাই যেহেতু বলেছেন, তাই নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায়, এই আন্দোলনের শুরুরদিকের দিনগুলোতে কর্মসূচী নির্ধারণে তার কৌশলগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রথমদিকের বাংলা ব্লকেড (যেটাকে পিনাকী ভট্টাচার্য ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করেছিলেন), পরের দিকের কমপ্লিট শাটডাউন, প্রোফাইল পিকচার লাল করা, পরবর্তীতে একদফা ঘোষণা এবং সর্বশেষ লংমার্চ টু ঢাকা – তাদের প্রতিটা কর্মসূচীই ছিল ব্রিলিয়ান্ট এবং সময়োপযোগী। এগুলোর যেকোনো একটা যদি না হতো, শুধু তাই না, যদি ঠিক সময় মতো না হতো, তাহলেই হয়তো এই আন্দোলন পথ হারিয়ে ফেলতে পারত। এদিক থেকে এই কর্মসূচীগুলো যার বা যাদের মাথা থেকে এসেছে, তাদেরকে মাস্টারমাইন্ড তো বলাই যায়।

ইমেইলের মাধ্যমে নতুন পোস্টের আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে 40 জনের সাথে যোগ দিন।

কিন্তু এটা হচ্ছে অর্ধেক চিত্র। এর কোনোটাই সফল হতো না যদি না শেখ হাসিনা ছাত্রদেরকে রাজাকার বলত, যদি না আবু সাইদ দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াত, যদি না আন্দোলন প্রায় থেমে যাওয়ার পর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পুরো জাতিকে ভুল প্রমাণিত করে রাস্তায় নেমে আসত, যদি না রিকশাওয়ালারা-ফেরিওয়ালারা এগিয়ে আসত।

এবং এই যে একের পর এক এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, এবং এর মাধ্যমে আন্দোলনটাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়েছে, এগুলো কারও মাস্টার প্ল্যানের অংশ না। এগুলো ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। চেইন রিঅ্যাকশনের অংশ হিসেবে। একেকটা ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। মাহফুজ আব্দুল্লাহ বা তার সমন্বয়কদের কৃতিত্ব এখানেই যে তারা মূল আন্দোলনটা শুরু করেছিল, ব্রিলিয়ান্ট কিছু কৌশল নির্ধারণ করেছিল, প্রতিটা মুহূর্তে জনগণের পালস বুঝেছিল এবং এরপর প্রতিটা ক্ষেত্রে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

মাস্টারমাইন্ড মানে এক্ষেত্রে এটা না যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনা পরিকল্পনা করে রাখা, এরপর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু বাস্তবায়ন করা। বরং মাস্টারমাইন্ড মানে জাস্ট শুরুটা করে দেওয়া এবং সময়ে সময়ে গতিপথটা ঠিক করে দেওয়া।

মাস্টারমাইন্ডের উপর অতিরিক্ত ফোকাস করতে গিয়ে আমরা যেন সাধারণ ছাত্রজনতার ভূমিকাকে ছোট করে না দেখি। সবকিছুকে আগে থেকে ঠিক করে রাখা মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করে ছাত্রজনতাকে জাস্ট সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী ক্রীড়ানক হিসেবে না দেখি।

এই গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, যারা পেছন থেকে প্রভাব রেখেছে, তাদের প্রত্যেককেই যথাযথ ক্রেডিট দিতে হবে। কিন্তু অল্প কিছু মানুষকে অতিরিক্ত ক্রেডিট দিতে গেলে যেটা হয়, অন্যদের ভূমিকাগুলোকে গুরুত্বহীন বলে মনে হয়। একজনকে বঙ্গবন্ধু বানিয়ে বাকি সবার ভূমিকাকে গৌণ করে ফেলার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *