ইতিহাসের প্রথম গুপ্তচর কে ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। চাইনিজ সমরবিদ সান জু এবং ভারতীয় দার্শনিক চাণক্যের লেখায় গুপ্তচরবৃত্তির কৌশল সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু এগুলো মাত্র ২,৪০০ থেকে ২,৫০০ বছর আগেকার কাহিনী।
তাদের আগে কি গুপ্তচরবৃত্তি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। লিখিত ইতিহাস পাওয়া না গেলেও মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই গুপ্তচরবৃত্তির চল থাকার কথা।
লিখিত আকারে বিশ্বের প্রাচীনতম গুপ্তচরদের সন্ধান পাওয়া যায় ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত তথা ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি বইয়ের চতুর্থ বইয়ে। এবং সরাসরি না হলেও মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনেও পরোক্ষভাবে এই কাহিনীর ইঙ্গিত দেওয়া আছে।
“বুক অফ নাম্বার্স” নামে পরিচিত ওল্ড টেস্টামেন্টের এই গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে আনার পর হযরত মুসা (আ) কেনান ভূমিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কারণ ওটাই ছিল তাদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমি।
কিন্তু কেনান সম্পর্কে মুসা (আ)-এর পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ নিয়ে সেখানে গেলে সেখানকার মানুষরা, বিশেষ করে সেখানকার ক্ষমতাসীন শাসক কি তাদেরকে প্রবেশ করতে দিবে? নাকি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? সেই শাসক কতটা শক্তিশালী? তার সৈন্য-সামন্তের সংখ্যা কিরকম? রাজ্যের ভূ-প্রকৃতি এবং চারপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই বা কেমন?
কাজেই মুসা (আ) সিদ্ধান্ত নেন, পরিস্থিতি বোঝার জন্য তিনি সেখানে গুপ্তচর প্রেরণ করবেন, যারা গোপনে কেনানে গিয়ে সেখানকার বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে আসবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি বনী ইসরাইলের ১২টি গোত্র থেকে ১২জন স্পাইকে বাছাই করেন এবং তাদেরকে কেনানে প্রেরণ করেন। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী এরাই হচ্ছে সেই বিখ্যাত “টুয়েল্ভ স্পাইজ”।
আপনি যদি এসপিওনাজ জগত সম্পর্কে আগ্রহী হন, তাহলে আমার লেখা স্পাই স্টোরিজ (রকমারি লিঙ্ক এখানে) এবং স্পাই স্টোরিজ ২ (রকমারি লিঙ্ক এখানে) বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন। বই দুটোতে উঠে এসেছে এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি।
৪০ দিন ধরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর স্পাইরা ফিরে আসে। তাদের মধ্যে ১০ জনের রিপোর্ট ছিল মোটামুটি একইরকম: কেনান রাজ্যটিতে দুধ এবং মধুর তথা সুস্বাদু খাবারের কোনো অভাব নেই। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা আকৃতিতে বিশাল দৈত্যের মতো, প্রচণ্ড শক্তিশালী। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও অত্যন্ত মজবুত, এবং তাদেরকে পরাজিত করা একেবারেই অসম্ভব, এমনকি মুসা (আ)-এর আল্লাহ্ও যদি সাহায্য করেন, তারপরেও তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না।
বাকি দুজন স্পাইয়ে রিপোর্ট ছিল একটু ভিন্ন। যশুয়া এবং ক্যালেব নামের এই দুই স্পাই স্বীকার করেন, কেনানের সৈন্যরা অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু সেই সাথে তারা এটাও বলেন যে, আল্লাহ্র সাহায্য পেলে তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব।
কিন্তু ততোক্ষণে প্রথম ১০ স্পাইয়ের রিপোর্ট বনী ইসরাইলীদের মধ্যে চাউর হয়ে যায়। ফলে তারা তাদের কথাই বিশ্বাস করে। তারা আল্লাহ্র সাহায্যের প্রতি আস্থা না রেখে নতুন নেতার অধীনে মিসরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করে।
ফলে তাদের উপর আল্লাহ্র আযাব নেমে আসে এবং পরবর্তী ৪০ বছর পর্যন্ত তাদেরকে মরুর বুকে দিকভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে হয়। এই ৪০ বছরের মধ্যে ঐ ১০ স্পাইয়ের সবাই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বেঁচে থাকে কেবল যশুয়া এবং ক্যালেব, যারা সত্য রিপোর্ট দিয়েছিল।
এসবই ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবরণ। কুরআন শরিফে যদিও হুবহু ১২জন স্পাইয়ের কথা নেই, কিন্তু সূরা মায়িদার ২১ থেকে ২৬ আয়াতের মধ্যে বলা আছে, মুসা (আ) যখন তার লোকদেরকে বলেছিলেন প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করার জন্য, তখন “তারা” শক্তিশালী শাসকের অজুহাত দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেছিল।
তাদের মধ্যে কেবল দুইজন প্রবেশ করার পক্ষে ছিল। বাকিরা মুসা (আ)-কে বলেছিল, “আপনি এবং আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই অপেক্ষা করব।” এবং এরপর আল্লাহ তাদের এই অপরাধের জন্য ৪০ বছর পর্যন্ত ঐ ভূমিকে তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেন।
এই ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম গোয়েন্দাগিরির ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ৩,২০০ বছর আগেকার কাহিনী। এবং সেই প্রাচীন আমলেও স্পাইদের দেওয়া ইন্টেলিজেন্স এবং অ্যাসেসমেন্টের উপর জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করত।
তারাই পারত উপযুক্ত ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করে কোনো জাতিকে যুদ্ধে জেতাতে। আবার তারা যদি ভীরু, অলস বা কাপুরুষ হতো, ঝুঁকি নিতে ভয় পেত, তাহলে তাদের ম্যানিপিউলেট করা ইন্টেলিজেন্সের কারণে কোনো জাতির উপর ধ্বংস নেমে আসতে পারত।
এসপিওনাজ সংক্রান্ত আমার সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।