খেলার সাথে কি রাজনীতি মেশানো উচিত?

প্রশ্নটা জটিল। কিন্তু উত্তরটা খুবই সহজ – খেলার সাথে রাজনীতি সব সময়ই মিশে থাকে। নতুন করে মেশানোর কিছু নাই।

ইরানের ন্যাশনাল টিম যে সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীত গায়নি, সেটা পরিষ্কার রাজনীতি।

ইউরোপের অনেকগুলো টিম যে ওয়ান লাভ ব্যান্ড পরে খেলতে নামার ঘোষণা দিয়েও পরে ইয়েলো কার্ড খাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে গেছে, জার্মানি যে ওয়ান লাভের পক্ষে সাইন দেখিয়েছে, অনেকগুলো ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র এবং মিডিয়া যে এই ইস্যুতে বিশ্বকাপেরই বিরোধিতা করেছে, তার সবই রাজনীতি।

ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে যে ফিফা থেকেই সাসপেন্ড করা হয়েছে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে যে খেলার সুযোগই দেওয়া হয়নি, সেটাও রাজনীতি।

এর বিপরীতে ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনি ফুটবলারদেরকে ঠিক মতো খেলতেই দেয় না, স্টেডিয়াম বন্ধ করে দেয়, বিদেশে খেলার শিডিউল থাকলে ফ্লাইট ক্যানসেল করিয়ে দেয়, টার্গেট করে হাঁটুতে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়, এরপরেও যে তারা ফিফা থেকে নিষিদ্ধ হয় না, সেটাও রাজনীতি।

ফ্রান্সের রাজনীতিতে বা সমাজের অধিকাংশ সেক্টরে “আফ্রিকান ইমিগ্র্যান্ট”দের অনুপাত খুবই কম হওয়া সত্ত্বেও, এবং ফ্রান্সের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল প্রচণ্ড রকমের ইমিগ্র্যান্টস-বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ফুটবলে যে তাদের টিমে এই শক্ত-সমর্থ “আফ্রিকান ইমিগ্র্যান্ট”দের সংখ্যা বেশি, এই হিপোক্রেসিও রাজনীতি।

এবং এই “ইমিগ্র্যান্ট”দের বাবা-মারাও যে মোস্টলি ফ্রেঞ্চ স্পীকিং আফ্রিকান কান্ট্রিগুলো থেকে আসা, এগুলোও তো তাদের কলোনিয়ালিজমেরই লিগ্যাসি।

এতসব রাজনীতির মধ্যে ডুবে থাকার পরেও আপনি যদি মনে করেন খেলা একটা স্যাক্রেড জিনিস, সেটাকে রাজনীতির সাথে মেশালে তার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে, তাহলে স্যরি টু সে, আপনি একটা বোতাতোদা।

খেলার সাথে রাজনীতি মিশে আছে এবং থাকবে। কিন্তু এরপরেও একজন মানুষ কোনো দল সাপোর্ট করার সময় খেলার সৌন্দর্য বিবেচনা করে সাপোর্ট করবে, নাকি রাজনীতি বিবেচনা করে সাপোর্ট করবে, সেটা যার যার ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স হওয়া উচিত।

কারো রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি থাকলে সে ইতিহাস এবং রাজনীতির উপর ভিত্তি করে কোনো দলকে সাপোর্ট দিতেই পারে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলো এশিয়ান, আফ্রিকান এবং আরবদেরকে যেরকম নিচু চোখে দেখে, এবং প্রকাশ্যেই যেরকম উন্নাসিকতা প্রকাশ করে, তাতে এই দেশগুলোর হাতে ইউরোপিয়ানদেরকে হারতে দেখলে অনেকেই আনন্দিত হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে গত বিশ্বকাপের পর জার্মানিতে মেসুত ওজিলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, কিংবা এবারের বিশ্বকাপে ইরানের “কালচার” নিয়ে ক্লিন্সম্যানের করা নেগেটিভ কমেন্ট উল্লেখযোগ্য। এগুলো সবও কিন্তু রাজনীতিরই অংশ।

ফলে যেসব ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক শোষণের কারণে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যাদের কারণে এই দেশগুলো আর কোনোদিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, এখনও যাদের স্বার্থের কারণে এই দেশগুলো পলিটিক্যালি আনস্টেবল হওয়ার কারণে অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি ঘরোয়া লীগকেও উন্নত করতে পারছে না, সেই তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশই যখন তাদের সাবেক কলোনিয়াল প্রভু রাষ্ট্রগুলোকে হারিয়ে দেয়, তাদের ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারে কিছুটা কালিমা লেপন করে দেয়, তখন তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমরা অনেকেই সেটার সাথে একাত্ম অনুভব করতে পারি। এটা পুরোটাই আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতার অংশ।

তাছাড়া বিশ্বকাপ শুধু নিছক “খেলা”ই না। এটা একটা বিশ্বমঞ্চ। নিজেকে, নিজের দেশের নামকে, নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার অপূর্ব সুযোগ। শুধু এ কারণেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লস হবে জেনেও বিভিন্ন দেশ বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য এত মরিয়া থাকে, ফিফার কর্তকর্তাদেরকে ঘুষ দেয়। এই আয়োজন করার মধ্য দিয়েই তারা বিশ্বের দরবারে নিজেকে, নিজের কালচারকে রিপ্রেজেন্ট করতে চায়। জাস্ট “খেলা”কে ভালোবেসে কেউ এই আয়োজন করে না।

খেলা আয়োজন করা এবং খেলায় জেতা তাই রাজনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক। খেলায় জিতলে বা ভালো করলে যে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যায়, সেটাও সেই দেশের জন্য, সেই জাতির সংস্কৃতির জন্য পিআর ক্যাম্পেইনের কাজ করে। স্ট্যানফোর্ড এবং ইয়েল ইউভার্সিটির কয়েকজন গবেষক তাদের এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, মোহাম্মদ সালাহ লিভারপুল এফসি ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে টুইটারে অ্যান্টি-মুসলিম হেটস্পীচ এবং লিভারপুল এরিয়াতে হেট ক্রাইম উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

খেলায় জেতার পর শুধু নিজেকে নিয়ে, নিজের কোচকে নিয়ে, নিজের টিমকে নিয়ে মাতামাতি না করে যে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়, নিজের মাকে মাঠে এনে সম্মান জানানো যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনজাস্টিসের শিকার, নিজের ফিলিস্তিনি ভাইদের কথা স্মরণ করা যায়, মরক্কোর জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী এখন এই শিক্ষাগুলোও পাচ্ছে।

ইউরোসেন্ট্রিক এই বিশ্বে, যেখানে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমাদের হাতে, যেখানে মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র নেগেটিভভাবেই উপস্থাপন করা হয়, ফিলিস্তিনের নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেওয়া হয়, সেখানে এইটুকু এক্সপোজার পাওয়ার জন্যেও অনেকে খেলার সাথে রাজনীতি মেশাতে পারে, ইউরোপের কোনো টিমের পরিবর্তে “মুসলমান” টিমকে সাপোর্ট করতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হবে যদি এই খেলার সাথে রাজনীতি মেশানোর মধ্যে বাড়াবাড়ি চলে আসে। সবাই রাজনৈতিকভাবে সমান সচেতন না – এটাই বাস্তবতা। এবং অনেকে যুদ্ধের ময়দানে কোনো দেশের বিরুদ্ধে থাকলেও খেলার শৈল্পিকতার কারণে ঐ দেশের টিমের সাপোর্টার হতেই পারে। তাদের সেই অধিকার থাকা উচিত।

একদিকে “খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না” বলাটা যেমন বাস্তবতা বিবর্জিত উপদেশ, তেমনি অন্যদিকে কেউ যদি নিজের রাজনৈতিক প্রেফারেন্সটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়, যদি বলে “অমুক দেশ তমুক দেশের সাথে এই অন্যায় করেছিল, কাজেই তাকে সাপোর্ট করা যাবে না, করলে আপনি খাঁটি মুসলমান/দেশপ্রেমিক না”, তাহলে সেটাও বাড়াবাড়ি হবে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *