শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়ার আরব বসন্তও ব্যর্থ হয়েছে।
অ্যাজ এক্সপেক্টেড, এই নিউজে কেউ কেউ খুবই খুশি। যেমন লিবিয়াতে হাফতারপন্থীরা, মিসরে সিসিপন্থীরা, সৌদি-ইমারাতে মাদখালিরা। এবং পুরো আরবে মোটামুটি সেক্যুলাররা।
কিন্তু ইন্টারেস্টিংলি, বাংলার ফেসবুকে সেক্যুলারদের এটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। বরং এখানে খুশি ইসলামপন্থীরাই। তাদের লজিক – আগেই বলেছিলুম, এত উদারতা দেখাইও না। এখন বুঝলা তো? হুঁহ!
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মুরসির মতো কিছুটা কট্টরপন্থা বা গান্নুশির মতো উদারপন্থাই তাদের সরকার পতনের একমাত্র কারণ না। এবং শুধু ইসলামপন্থীদেরই পতন হয় না। সরকার পতনের পেছনে অনেক অনেক অনেক কারণ থাকে।
গাদ্দাফির মতো সেক্যুলার, কট্টর আমেরিকা-বিরোধী নেতারও পতন হয়েছে। সাদ্দাম যখন প্রো-আমেরিকান ছিল, তখনও তার উপর বম্বিং হয়েছে, এরপর যখন অ্যান্টি-আমেরিকান হয়েছে, তখনও তার পতন ঘটেছে।
মোবারকের মতো ইসরায়েলপন্থী আর বেন-আলির মতো ফ্রান্সপন্থী সেক্যুলার শাসকদেরও পতন ঘটেছে। সো দেয়ার ইজ নো ওয়ে টু জেনারেলাইজ যে, এই পন্থী হলে টিকে থাকা যাবে, ঐ পন্থী হলে পতন ঘটবে।
আরব বসন্তের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে মোটাদাগে দুইটা ব্লকের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। একদিকে আছে প্রো-রেভোল্যুশনারি, প্রো-ডেমোক্রেসি, মডারেট ইসলামিস্ট ফোর্সেস, সাপোর্টেড বাই টার্কি অ্যান্ড কাতার। আর অন্যদিকে আছে কাউন্টার রেভোল্যুশনারি, প্রো-মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ, সাপোর্টেড বাই ওল্ড গার্ডস, মাদখালি সালাফিজ অ্যান্ড সাউদি-ইমারাতি গভর্নমেন্ট।
মিসর, লিবিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া – প্রতিটা দেশেই একই সমীকরণ। এবং এতে কে কট্টর, কে উদার, সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। নির্ভর করেছে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর – সেই দেশের গুরুত্ব কতটুকু, সেখানে ব্যাকারদের স্বার্থ কতটুকু, সেই দেশের মিলিটারি পাওয়ার স্ট্রাকচার কীরকম, ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং সেই সাথে আরও একটা বিষয় – সরকারের পক্ষে পাবলিক সাপোর্ট কীরকম।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আমার সবগুলো লেখা পাবেন এই লিঙ্কে।
দেখেন, মিসরে এবং তিউনিসিয়ায় – উভয় দেশেই যা হয়েছে, তা পরিষ্কার ক্যু। কিন্তু তারপরেও এই ক্যু ঘটনার জন্য তাদের কিছু অজুহাত দরকার পড়েছে। মিসরে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুরসির বিরুদ্ধে মাঠে নামার পরেই সিসি সেই সুযোগ পেয়েছে। এবং তিউনিসিয়ায় সরকার কোভিড নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ার পরেই কায়েস সাঈদ ক্যু করার সুযোগ নিয়েছে।
লক্ষণীয়, তিউনিসিয়ার ক্যুয়ের পরিকল্পনা আরও আগেই হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সেটা বাস্তবায়ন করেছে তখন, যখন কোভিড সিচুয়েশনের ভয়াবহ অবনতির পর জনরোষ তীব্র।
সুতরাং ঘান্নুশি যদি আরও উদার হতো বা আরও কট্টর হতো, তাহলেও নাহদা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারত – এরকম কোনো লক্ষণ নাই। বরং তারা যদি আরও দক্ষ এবং যোগ্য থাকত, তাদের যদি আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা থাকত, দেশটার পাওয়ার স্ট্রাকচার যদি ভিন্ন হতো, তাহলে হয়তো তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকত। তাহলে হয়তো ক্যুয়ের ঘোষণার পরেও তুরস্কের মতো জনগণ রাস্তায় নেমে এসে ক্যু ব্যর্থ করে দিতো।
কাজেই টিকে থাকার জন্য আরও উদার হওয়া বা আরও কট্টর হওয়া না, বরং আমাদের সামনে সফল উদাহরণ এখন পর্যন্ত একটাই – সুলতান রিসেপ তায়িব এরদোয়ানের মতো হাফ সেক্যুলার, হাফ ইসলামিস্ট, শ্রুড পলিটিশিয়ান হওয়া। লাভ হিম অর হেট হিম, বাট পলিটিশিয়ান হিসেবে এরদোয়ানের মতো যোগ্য নেতা যে শত বছরে একজন জন্মায়, এটা স্বীকার না করে আপনার উপায় নাই।
তবে এরদোয়ানও তো একদিনে তৈরি হয়নি। একাধিকবার কট্টর-সেক্যুলার সামরিক শাসনের পরই এরদোয়ানের আবির্ভাব ঘটেছে। মিসর বা তিউনিসিয়া এখনও সেই স্টেজ অতিক্রম করেনি। তাই আপাতত তাদের সরকারের পতন খুব একটা অপ্রত্যাশিতও না।
আরও পড়ুন: মিসরের ২৫ জানুয়ারি আন্দোলনের পটভূমি
তবে সব পতন, বা সব বিপ্লবের ব্যর্থতা কিন্তু একরকম না। লিবিয়াতে বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে দেশটা কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রতিটা ইন্সটিটিউশন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে, সোশ্যাল ফ্যাব্রিক নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
মিসরের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। সেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে সত্য, ব্রুটাল ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য, কিন্তু ইনস্টিটিউশনগুলো এখনও টিকে আছে, ইকোনমি ধীরে ধীরে রিকভার করছে। আনলাইক লিবিয়া, মিসরে দশ, পনেরো, বিশ বছর পরে আবারও ড্রামাটিক পরিবর্তন আসতে পারে।
এবং তিউনিসিয়ার ক্যুয়ের চরিত্রটা যদিও এখনও বোঝার সময় হয়নি, কিন্তু সেখানে যদি মিসরের মতো অবস্থাও হয়, তারপরেও সেটা এই তিন দেশের মধ্যে বেস্ট এই কারণে যে, সেখানে এই পরিবর্তনটা ঘটেছে বিনা রক্তপাতে। ঘান্নুশির উদারপন্থার যদি কোনো ভালো দিক থেকে থাকে, এটা তার একটা।