ওমেন্স কর্নারে আমার সাক্ষাৎকার: সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ভাবনা

গত আগস্টের ১২ তারিখে ওমেন্স কর্নারের পক্ষ থেকে আমার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরার সুযোগ পাই। সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে দেওয়া হলো। এছাড়া কেউ চাইলে মূল লিঙ্ক থেকেও পড়তে পারেন।

সোশ্যাল মিডিয়া বর্জন নয়, সতর্ক ব্যবহারই সমাধান: ত্বোহা

মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা! দেশে না থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের নানান বিষয়ে বেশ সক্রিয়। নিজস্ব মতামত প্রদান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ন্যায়ের পক্ষে সাধুবাদ বরাবর দিয়ে আসছেন। দিনকে দিন সোস্যাল মিডিয়া সকলের জন্য যেন বিষাক্ত হয়ে উঠছে! সমসাময়িক নানান ইস্যুসহ সোস্যাল মিডিয়ার ভালোমন্দ দিক নিয়ে আজকে তার সাথে কথা বলবো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার। 

ওমেন্সকর্নার : ছোটবেলা থেকে লিবিয়ায় থাকছেন। তবুও দেশের প্রতি আপনার অনেক টান। এতো টান অনুভব করেন কিভাবে ? 

ত্বোহা : এটাকে ঠিক টান বলে কিনা জানি না। কিন্তু লিবিয়ায় থাকলেও আমি এইচএসসি পর্যন্ত এখানকার বাংলাদেশী স্কুলে পড়াশোনা করেছি, বাংলাদেশী কমিউনিটিতে মিশেছি, এবং এরপর ইন্টারনেট আসার পর থেকেই ব্লগ, ফোরাম এবং ফেসবুকে বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথেই বেশি ইন্টার‍্যাক্ট করেছি।

ইউরোপ-আমেরিকায় যারা বড় হয়, তারা যেরকম সেখানকার সমাজের সাথে মিথে দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি। বাংলাদেশকে কাছ থেকে দেখিনি বেশি, কিন্তু অনলাইনে বা অফলাইনে সব সময়ই বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথেই আমার যোগাযোগটা বেশি ছিল। টান যদি বলেন, সেটা হয়তো সেখান থেকেই এসেছে। 

ওমেন্সকর্নার : সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ ?

ত্বোহা : দুটোই। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একে অন্যের সাথে ইন্টার‌্যাক্ট করতে পারছে, পরস্পরের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করতে পারছে, ফলে অনেক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের আবেদন করে মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে। এগুলো বাদ দিলেও বাস্তব জীবনের দম বন্ধ করা পরিবেশের বাইরে মানুষ এখানে নিছক বিনোদনের বা মনের কথা অকপটে প্রকাশ করার একটা জায়গা খুঁজে পাচ্ছে।

কিন্তু এর বিপরীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণার চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনি সামনা সামনি একজন মানুষকে কটু কথা বলতে পারবেন না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ সমানে একে অন্যকে গালাগালি করছে। কোনো ঘটনা পুরোপুরি না জেনেই সেটাকে ভাইরাল করে দিচ্ছে। লাইক পাওয়ার জন্য, ভাইরাল হওয়ার জন্য অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কাজ করছে। 

কাজেই এর ভালোমন্দ দুটো দিকই আছে। বর্জন করা যেহেতু অনেক বেশি কঠিন, এবং অনেক ক্ষেত্রে কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ, তাই বাস্তবসম্মত সমাধান হচ্ছে এর অভিশাপগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা, এবং আশীর্বাদগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা।

ওমেন্সকর্নার : সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ ভাইরাল ‘ । এই ‘ ভাইরাল ‘ দিনকে দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে বলে আপনি মনে করেন  এবং কেন ?

ত্বোহা : ভাইরালের আসলে দুইটা দিক আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল না হলে কোনো অপরাধের বিচার পাওয়া যায় না। এই দিকটা মন্দের ভালো। কিন্তু এর বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই যেসব অভিযোগ বা যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়, সেখানে পুরো চিত্রটা উঠে আসে না।

খণ্ড একটা চিত্র দেখেই মানুষ কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানে। এরফলে সামাজিকভাবে তার যতটুকু ক্ষতি হয়, অনেক সময় সেটা তার মূল অপরাধের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর অভিযুক্ত যদি নির্দোষ হয়ে থাকে, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এ ধরনের একেকটা ভাইরাল পোস্ট বা ভিডিও একেকটা লাইফকে ধ্বংস করে দিতে পারে। 

ওমেন্সকর্নার :  মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ দুইপিঠই থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ারও ভালো – মন্দ দুইদিন রয়েছে। আমরা কোন দিকটা বেশি ব্যবহার করছি এবং এর কারণ কী ?

ত্বোহা : আমরা সম্ভবত মন্দ দিকটাই বেশি ব্যবহার করছি। কারণ হিসেবে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু সবচেয়ে সিম্পল কারণটা প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন – ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। 

ওমেন্সকর্নার : চারপাশে মানবিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় কেন ?

ত্বোহা : এটা তো এক কথায় বলা সম্ভব না। অনেকগুলো কারণ আছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে নাগরিক ব্যস্ততার কারণে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়া। বাবা-মারা এখন অর্থ উপার্জন করে ঠিকই, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সন্তানকে সময় দিতে পারে না। যে শিক্ষা এবং মূল্যবোধ ছোটকালে পরিবার থেকে আসার কথা, সেটাতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে যায়। সেই সাথে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব, সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব এগুলো তো আছেই।

ওমেন্সকর্নার : সম্প্রতি এক নায়িকাকে কেন্দ্র করে পুরো বাংলাদেশ উত্তাল। একই ঘটনা লিবিয়াতে ঘটলে কিভাবে দেখা হতো ?

ত্বোহা : লিবিয়ার সাথে তুলনা করাটা আসলে কঠিন। লিবিয়ান সোসাইটি খুবই কনজার্ভেটিভ। সম্ভবত আরব বিশ্বের সবচেয়ে কনজার্ভেটিভ সোসাইটিগুলোর মধ্যে একটা। লিবিয়াতে এমনকি কোনো সিনেমা হল নেই, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নেই। সুতরাং আমরা এ ধরনের ব্যাপারগুলো যতটুকু গ্রহণ করতে পারছি, লিবিয়ানরা ততটুকুও গ্রহণ করতে অভ্যস্ত না। আমার ধারনা লিবিয়াতে এরকম ঘটনা ঘটলে সেখানেও প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশে কম হতো না। 

ওমেন্সকর্নার :  লেখালিখি নিয়ে কিছু বলুন। নতুন বই কবে পাবো ?

ত্বোহা : স্পাই স্টোরিজ-২ আনার পরিকল্পনা আছে সামনের বইমেলায়। এটাও প্রথমটার মতোই এসপিওনাজ জগতের দুর্ধর্ষ কিছু স্পাইর অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে এর কলেবর স্পাই স্টোরিজ প্রথমটার চেয়ে অনেক বড় হবে। এছাড়াও মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে একটা বইয়ের কাজে হাত দিয়েছিলাম। সেটা শেষ করার চেষ্টা করব। 
 
ওমেন্সকর্নার : বাংলাদেশের প্রতি আপনার গভীর টান আছে অনেক প্রমাণ পেয়েছি। দেশের জন্য নিজ উদ্যোগে কিছু করার পরিকল্পনা আছে ?

ত্বোহা : এরকম প্রশ্নের জবাবে সম্ভবত নির্দিষ্ট ফরম্যাটের সুন্দর সুন্দর কিছু কথা বলতে হয়। আমি সেদিকে না গিয়ে বরং অনেস্ট একটা রিপ্লাই দেই: নাহ, সেরকম কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। দেশ বিশাল একটা ব্যাপার। দেশের জন্য কাজ করাটাও বিশাল ব্যাপার। সবার সেই সৌভাগ্য হয় না, এবং সবার আসলে সেরকম কিছু করার দরকারও নেই।

বরং আমার দর্শন হচ্ছে, আমি যদি খারাপ বা অনৈতিক কিছু না করি, নিজের জন্যই ভালো কিছু করি, যাতে নিজের এবং আশেপাশের কয়েকজনের উপকার হয়, তাহলে তাতেই দেশের জন্য সামান্য কিছু করা হয়। সবাই যদি এভাবে অন্যের ক্ষতি না করে নিজের জন্যই কিছু না কিছু করে, তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের জন্য আলাদা করে খুব বেশি কিছু করতে হবে না।  

ওমেন্সকর্নার : যেহেতু ওমেন্সকর্নারে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। ওমেন্সদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলুন। আপনার দৃষ্টিতে আমাদের সমাজে নারীদের অগ্রগতি কতদূর ? নারীরা তাদের প্রাপ্ত সুযোগ – সুবিধা, সম্মান এবং মেধার যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে ? 

ত্বোহা : আমাদের সমাজে নারীদের অগ্রগতিকে আমি মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করি। বিপুল সংখ্যক নারী এখনও তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা, সম্মান থেকে বঞ্চিত। তারা তাদের শ্রমের মূল্য পায় না, পরিবারে তাদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তাদেরকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হয় না, তারা ঘরের কাজের স্বীকৃতি পায় না, যৌতুকের জন্য তাদেরকে এখনও নির্যাতন সইতে হয়, শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে পথেঘাটে অনেক কথা শুনতে হয়। এগুলো নিয়ে আমাদের এখনও অনেক অনেক অনেক কাজ করার আছে।

এর বাইরে সমাজের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশের নারীরা স্বাবলম্বী, স্বাধীন, সুবিধাভোগী। কিন্তু সমাজের ক্ষুদ্রে একটা অংশের হওয়ার কারণে তারা অনেকটা বাবলের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। যেখানে তাদের উচিত সমাজের বিপুল সংখ্যক নারীর মৌলিক অধিকারগুলো আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেওয়া, সেখানে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ে থাকে নিজেদের বাবলের নারীদের শুধু স্বাধীনতা না, বরং স্বেচ্ছাচারিতার দাবি নিয়ে। বিশেষ করে অনলাইনে এই চর্চাটা আপনি বেশি দেখবেন।

এখানে তথাকথিত নারীবাদীদের একটা অংশ এই মৌলিক দাবিগুলো বাদ দিয়ে নারীদের প্রকাশ্যে ধুমপানের অধিকার, যৌনতার অধিকার, পরকীয়ার অধিকারসহ এমনসব বিষয় নিয়ে সোচ্চার থাকে, যা বাস্তবে টক্সিসিটি ছড়ানো ছাড়া দেশের নারীদের যে আসল সমস্যা, সেগুলোর সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখে না।

ওমেন্সকর্নার : পাল্টা আরেকটি প্রশ্ন। অতীতের তুলনায় বর্তমানে নারীরা যথেষ্ট সুযোগ – সুবিধা পাচ্ছে। তারা এই সুযোগের সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারছে ?

ত্বোহা : আমার মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে পারছে। এবং অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রে এখনও পারছে না, সেগুলোও হয়তো সময়ের ব্যাপার। ধীরে ধীরে আরও পরিবর্তন আসবে।

ওমেন্সকর্নার : সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীরা কতটা নিরাপদ এবং একইসাথে কতটা প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন ?

ত্বোহা : এটা সম্ভবত নিজের একটা ফেক নারী অ্যাকাউন্ট না থাকা পর্যন্ত ছেলে হিসেবে আমি পুরোপুরি বুঝতে পারব না। কিন্তু যতটুকু দেখছি এবং শুনছি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও নারীরা প্রতিনিয়ত প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। একই অপরাধে একজন নারী এবং একজন পুরুষ জড়িত থাকলে নোংরা কমেন্টগুলো নারীদের বিরুদ্ধেই বেশি যায়। এবং এটা প্রকাশ্যেই। ইনবক্সে তাদেরকে আরও কত হয়রানির শিকার হতে হয়, সেটা হয়তো আমরা পুরোপুরি বুঝতেও পারব না। আমাদের মানসিকতায় এখনও অনেক পরিবর্তন দরকার।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *