অনলাইন সিকিউরিটির কথা উঠলে অধিকাংশ মানুষকেই বলতে শোনা যায়- আমার তো গোপন করার এমন কিছু নাই, কাজেই গুগল, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ আমার তথ্য নিলে বা সেই তথ্য অন্য কারো কাছে বিক্রি করলে আমার কী আসে যায়?
এ ধরনের কথা শুনতে খুব যৌক্তিক শোনায়। আসলেই তো! আমার তথ্য চুরি করে কে কাজে লাগাবে? হয়তো কোম্পানিগুলো, অথবা রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা। তো আমাদের, মানে আমরা যারা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করি, যারা অনলাইনে মাঝে মাঝে টুকটাক লেখালেখি করলেও বাস্তবে কোনো রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটির জড়িত না, যারা কোনো “এক্সট্রিমিস্ট” আইডিওলজি ধারণ করি না, খুবই সাধারণ জীবন যাপন করি, তাদের তথ্য যদি সরকার চুরি করেও, করুক না! সমস্যা কী?
আর যদি তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে আমাদের তথ্য বিক্রি করে, তাহলেই বা সমস্যা কী? কোম্পানিগুলো আমাদের বিভিন্ন লাইক-কমেন্টের উপর ভিত্তি করে বুঝে ফেলবে আমরা কোন ধরনের প্রোডাক্ট পছন্দ করি? এরপর সেই ধরনের প্রোডাক্টের পণ্যের বিজ্ঞাপন আমাদের সামনে হাজির করবে? খারাপ কী? বরং এটাই তো ভালো! না চাইতেই চোখের সামনে কিনতে আগ্রহী পণ্যের বিজ্ঞাপন এসের হাজির হবে, ফলে কেনাকাটার ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে যাবে। ক্ষতি কী?
ক্ষতিটা আসলে এই জায়গায় না, অন্য জায়গায়। আপনার তথ্য শুধু আপনার সামনে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য বা আপনি সন্ত্রাসী কি না, সেটা বের করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। আপনার তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আগামী দিনগুলোতে আরও বেশি ব্যবহৃত হবে আপনাকে এমনভাবে ম্যানিপুলেট করার কাজে, যেটা আপনি হয়তো এখনও কল্পনাও করতে পারছেন না।
খুবই সিম্পল দুইটা উদাহরণ দেই। আমেরিকা এবং ব্রিটেনের দিকে তাকান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুইটা দেশের রাজনীতিতে এবং তার ফলে দেশের অর্থনীতি, সমাজসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে যে জিনিস দুইটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটা হচ্ছে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া এবং ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট)। এবং এই দুইটা ঘটনার পেছনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল থার্ড পার্টি একটা অ্যাপ, যারা ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের তথ্য নিয়ে সেটা দিয়ে ইউজারদেরকে ম্যানিপুলেট করেছে।
সহজ ভাষায় তারা যেই কাজটা করেছে, সেটা হচ্ছে ফেসবুকের লাইক-কমেন্ট প্যাটার্ন থেকে এমন মানুষদেরকে খুঁজে বের করেছে, যারা কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থক না। এরপর তাদের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী তাদের সামনে টার্গেটেড অ্যাড হাজির করেছে। ফলে ব্যবহারকারীরা, যাদের দেশের রাজনীতি সম্পর্কে গভীর কোনো ধারণা নাই, যারা এমনিতে হয়তো ভোটও দিত না, তারা অন্য কিছু না জেনে, দেশের উপর সার্বিক কী প্রভাব পড়বে সেটা না বুঝে, ঐ টার্গেটেড অ্যাড দেখে নিজেদের অজান্তেই ধীরে ধীরে প্রভাবিত হয়ে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে, ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিয়েছে। ফলাফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
ব্যক্তিগত জীবনেও যখন সরকারগুলো বা বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত গোপন তথ্য জেনে যাবে, সেটা শেষ পর্যন্ত আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে। দশ বছর পরের আমেরিকা বা ইউরোপের কথা কল্পনা করুন। ধরুন সেখানে তখন ক্ষমতায় ট্রাম্পের চেয়েও বড় কোনো ইসলামোফোব, আলট্রা রাইট, পপুলিস্ট নেতা। এবার ধরুন আপনি অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র। কারো সাতে-পাঁচে থাকেন না। কোনো পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজম করেন না। কাজেই ফেসবুকের তথ্য চুরি নিয়েও আপনার কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু একদিন হঠাৎ আপনি খেয়াল করলেন, সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাবলে আমেরিকা বা ইউরোপের বেস্ট একটা ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে আপনাকে ভিসা দেওয়া হয়নি। কেন? আপনি হয়তো জানবেনও না, কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণও হয়তো প্রভাবিত হয়েছে আপনার স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ডাটার কারণে।
হয়তো আপনার ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে আপনি এমনিতে কিছু না করলেও দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, কথায় কথায় বিভিন্ন আরবি/ধর্মীয় এক্সপ্রেশন ব্যবহার করেন। ফলে বর্তমানে কিছু না করলেও আপনি ঐ দেশগুলোর সিকিউরিটির জন্য পটেনশিয়াল থ্রেট। তাদের কালচারের জন্য হুমকি। তাদের কাছে যখন আপনার পার্সোনাল লাইফের এই তথ্যগুলো থাকবে, তখন তারা কেন আপনাকে ভিসা দিবে? দেখা যাবে প্রচণ্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শুধু এই কারণেই আপনি বঞ্চিত হবেন।
একই ব্যাপার ঘটতে পারে বিপরীত ক্ষেত্রেও। আপনি একজন বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলী, তুরস্কের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিতে বা ইরানের নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটিতে দারুণ একটা জব পেয়ে গেলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে, যদি তারা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পারে আপনি আল-জাজিরা, টিআরটি বা পার্স টুডে পছন্দ করেন না, পছন্দ করেন বিবিসি আর সিএনএন।
সো আপনার গোপন করার কিছু নাই – ব্যাপারটা সত্য না। এটা একটা ইল্যুশন। আপনার তথ্য আপনার বিরুদ্ধেই যে কতভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সে ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণাই নাই। আমারও নাই। উপরের দুইটা উদাহরণ খুবই স্থূল, খুবই সিম্পল। বাস্তবে সুপার কম্পিউটার আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটা আপনার পক্ষে এখনও কল্পনাও করাই সম্ভব না।
কিন্তু এটা একদিনে হবে না। হবে ধীরে ধীরে। এবং নিশ্চিতভাবেই হবে, যদি সবাই মনে করে- আরে আমার তথ্য নিয়ে কী করবে! কিন্তু যদি সবাই আগে থেকেই সচেতন হয়, যদি প্রতিবাদ করে, কোনো অ্যাপ বাড়াবাড়ি করলে সেটা বর্জন করে, তাহলে এই প্রসেস কিছুটা হলেও বিলম্বিত হবে, বিকল্প অ্যাপ তৈরি হবে, বিনা অনুমতিতে তথ্য সংগ্রহের বিরুদ্ধে আইন আরো কঠিন হবে।
আমার গোপন করার কিছু নাই, তাই আমি নীরব থাকব- এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। এডওয়ার্ড স্নোডেনের ভাষায়:
Arguing that you don’t care about the right to privacy because you have nothing to hide is no different than saying you don’t care about free speech because you have nothing to say.
— Edward Snowden in Permanent Record
এই লেখাটা প্রথমে লিখেছিলাম ফেসবুকে। আপনার যদি এই লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন: