বানিয়ালুলু বইয়ের লেখক শিবব্রত বর্মনের কোনো লেখা আমি আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। দুর্ভাগ্যটা আমারই। কারণ এখন দেখতে পারছি তিনি যথেষ্ট বিখ্যাত লেখক, প্রথম-আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত তার লেখা প্রকাশিত হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, তিনি লেখেনও দুর্দান্ত।
সম্প্রতি চরকি অ্যাপে রিলিজ পাওয়া “ঊনলৌকিক” ওয়েব সিরিজটা দেখতে গিয়েই মূলত আমি শিবব্রত বর্মন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। সিরিজটা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেছি, এখানে তাই আর বিস্তারিত বলছি না।
কিন্তু যে ব্যাপারটা ঘটেছে, সিরিজটার প্রতিটা এপিসোডের কাহিনী এমন অদ্ভুত আর এত চমৎকার, সেটা দেখতে গিয়েই আমার মনে হয়েছে, এর চিত্রনাট্য সরাসরি ওয়েব সিরিজের জন্য লেখা হয়নি। বরং আগে সম্ভবত ছোটগল্প আকারে লেখা হয়েছিল, পরে সেখান থেকে অ্যাডাপ্ট করে চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে।
সিরিজ দেখার পর সার্চ করে দেখি আসলেই আমার ধারণা সঠিক। সিরিজের দুইটা এপিসোডের গল্প নেওয়া হয়েছে তার “বানিয়ালুলু” নামক গল্পগ্রন্থ থেকে। সিরিজটা দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম, দেরি না করে বানিয়ালুলু বইটাও পড়ে ফেললাম।
বানিয়ালুলুকে ঠিক সায়েন্স ফিকশন বলা যায় না। ঊনলৌকিকের কাহিনীগুলোর মতোই এই বইয়ের গল্পগুলোও সাইফাই এবং ফ্যান্টাসির মিশেলে তৈরি। অনেকটা অতিপ্রাকৃতিক ঘরানার। মোট এগারোটা গল্প আছে। সবগুলো গল্পের জঁনরাই মোটামুটি একই রকম। এবং সবগুলোই সুন্দর।
বানিয়ালুলু নামটা শুনতে অদ্ভুত। বইয়ের পাশাপাশি এটা প্রথম গল্পটার নামও। নামটার কোনো অর্থ নাই। শব্দটা মূলত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উল্টাপাল্টা টুইটকে ব্যাঙ্গ করে বানানো হয়েছে।
কাহিনীটা খুবই ইন্টারেস্টিং। ডোনাল্ড ট্রাম্প আটটি দেশের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরমধ্যে সাতটি দেশের নাম আমাদের পরিচিত। কিন্তু অষ্টম দেশটির নাম এর আগে কেউ শোনেনি। সেই দেশটিই হচ্ছে “বানিয়ালুলু”।
প্রজ্ঞাপন জারির কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য সেটি সংশোধন করা হয়। বানিয়ালুলুর নাম কেটে দিয়ে বাকি সাতটি দেশের নাম প্রকাশ করা হয়। সবাই ধরে নেয়, ওটা ছিল অনিচ্ছাকৃত ভুল। কিন্তু এক ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট ব্যাপারটাকে এত সহজে ছাড় না দিয়ে তদন্ত শুরু করে।
তার তদন্তে উঠে আসতে থাকে অদ্ভুত সব তথ্য। বানিয়ালুলু নামে আসলেই একটা দেশ আছে, যেই দেশটা সম্পর্কিত সকল তথ্য কঠোর গোপনীয়তার সাথে সেন্সর করা হয়েছে! স্টেট ডিপার্টমেন্টের আর্কাইভ থেকে টুকরো-টুকরো তথ্য জোড়াতালি দিয়ে সে চেষ্টা করতে থাকে দেশটা সম্পর্কে বোধগম্য একটা চিত্র দাঁড় করানোর। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার নিজের উপরেই বিপদ নেমে আসে …
বানিয়ালুলু বইয়ের যে গল্পটা আমার কাছে সবচেয়ে অসাধারণ লেগেছে, সেটা হচ্ছে “প্রতিদ্বন্দ্বী”। দেশবিখ্যাত দুই উর্দু কবির মধ্যকার দ্বন্দ্বের গল্প। সুলতান চুঘতাই নামক কবির দাবি, তার সকল পাণ্ডুলিপি তালাল লুধিয়ানি নামের আরেক বিখ্যাত কবি চুরি করে প্রকাশ করে ফেলছেন।
তার অভিযোগ অত্যন্ত যৌক্তিক। লুধিয়ানির নতুন প্রকাশিত বইয়ের কবিতাগুলোর স্টাইলের সাথে তার আগের স্টাইলের কোনো মিল নেই। বরং সেগুলো হুবহু চুঘতাইয়ের কবিতার মতো। কিন্তু তারপরেও এই পাণ্ডুলিপি চুরির বিষয়টি চুঘতাই প্রমাণ করতে পারছেন না।
কারণ তার ঘরের সিন্দুক থেকে পাণ্ডুলিপি চুরি হয়েছে, এমন কোনো আলামত নেই। এবং তিনি যে পাণ্ডুলিপিগুলো আগে লিখেছিলেন, তারও কোনো প্রমাণ নেই। হাকিমের আদালতে অভিযোগ করেও তাই চুঘতাই হেরে গেছেন। কারণ সেখানে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, লুধিয়ানির বিরুদ্ধে তিনি যেসব বই প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ এনেছেন, সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার মূল পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ হওয়ারও কয়েকমাস আগে!
উপায়ান্তর না দেখে তিনি ঢাকা থেকে এক বিখ্যাত আইনজীবীকে হায়ার করে আনেন তার পক্ষ হয়ে মামলা লড়ার জন্য। সেই আইনজীবীর কাজটা প্রায় অসম্ভব। তাকে প্রমাণ করতে হবে, চুঘতাই মূল পাণ্ডুলিপি লেখারও আগে লুধিয়ানি কীভাবে সেটা চুরি করে প্রকাশ করে ফেলে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই মাঠে নামেন আইনজীবী। লুধিয়ানির জন্য এক অভাবনীয় ফাঁদ পাতেন তিনি …
আমার লেখা সবগুলো বুক রিভিউ পড়তে পারবেন এই লিঙ্ক থেকে।
“প্রতিদ্বন্দ্বী” ছাড়া বানিয়ালুলু বইটির বাকি গল্পগুলো মোটামুটি সরল কাহিনীর। সবগুলোই শেষ হয় ছোটখাটো একটা রহস্য বা অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা দিয়ে। এরমধ্যে জাগার বেলা হলো আর দ্বিখণ্ডিত বাদে বাকিগুলোর এন্ডিংকে সেই অর্থে ঠিক প্লট টুইস্ট বা চমক বলা যায় না। কিন্তু ছোটগল্পের যে সংজ্ঞা – শেষ হয়েও হইলো না শেষ – এন্ডিংগুলো সেদিক থেকে পুরোপুরি সফল।
শিবব্রত বর্মনের সাফল্য যতটা না তার কাহিনীতে, তার চেয়ে অনেক বেশি তার লেখনীতে। বোঝা যায়, তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেশ ভালো এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞান প্রচুর, সফল লেখক হওয়ার যা অন্যতম পূর্বশর্ত। তার গতিশীল লেখনীর কারণে ১২৮ পৃষ্ঠার বইটি এক বসায়তেই পড়ে ফেলা সম্ভব। তার এ জাতীয় সাইফাই-ফ্যান্টাসির মিশেলে তৈরি ছোটগল্পের সংকলন আরও আছে কিনা, এখনও জানি না। থাকলে আগ্রহ নিয়েই পড়ব।
বানিয়ালুলু বইটাকে অনায়াসে ৪/৫ রেটিং দেওয়া যায়। বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে, বাতিঘর থেকে। বাতিঘর ছাড়াও পাওয়া যাবে অনলাইন বুকশপ রকমারিতে। বইটার প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী। বইটার প্রচ্ছদমূল্য ২৪০ টাকা।