আহেদ তামিমির আত্মজীবনী: আংশিক অনুবাদ

আহেদ তামিমি হচ্ছেন সেই ফিলিস্তিনি কিশোরী অ্যাক্টিভিস্ট, যিনি মাত্র ষোলো বছর বয়সে এক দখলদার ইসরায়েলি সেনাকে চড় এবং লাথি মেরে ভাইরাল হয়েছিলেন। কিন্তু এটা হচ্ছে তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ক্ষুদ্র একটা অংশ।

তামিমি পরিবারের সদস্যদের পুরো জীবনই কেটেছে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তার বাবা বাসেম আল-তামিমি ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তিনি অন্তত ১৫ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার মা নারিমান তামিমিও গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৫ বার। ইসরায়েলি পুলিশের গুলি খেয়ে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। তার এক চাচা মোস্তফা তামিমি ছিলেন নবী সালেহ গ্রামের প্রথম শহীদ।

আহেদ তামিমিকে নিয়ে রোর বাংলায় আমার একটা ফিচার আর্টিকেল আছে, যে আর্টিকেলটার জন্য আমি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রোর বাংলার সেরা ফিচার আর্টিকেল লেখক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলাম। আর্টিকেলটা পড়ে আসতে পারেন এখান থেকে

গত বছর এই আহেদ তামিমি প্রকাশ করেছেন তার আত্মজীবনী, They Called Me a Lioness: A Palestinian Girl’s Fight for Freedom। বইটা লিখতে তাকে সাহায্য করেছেন আল-জাজিরা ইন্টারন্যাশনালের ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক, দিনা তাকরুরি

বইটা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আমি এর কিছু কিছু অংশ ভাবানুবাদ করে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। এই আর্টিকেলটা সেই অনুবাদগুলোরই সঙ্কলন।

ফিলিস্তিনি শিশুদের খেলা: জাইশ ওয়া আরাব

“নবী সালেহ” গ্রামের অন্য সব শিশুর মতো ছোটকালে আমারও প্রিয় একটা খেলা ছিল “জাইশ ওয়া আরাব”। অর্থাৎ, “আর্মি এবং আরব”।

আমরা নিজেদেরকে দুটো দলে ভাগ করতাম: একটা দল হতো ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, আর অন্য দলটা হতো ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিদের দলে আমরা নিজেদেরকে ডাক্তার, সাংবাদিক এবং অবশ্যই প্রতিবাদকারীদের ভূমিকায় ভাগাভাগি করে নিতাম। যারা ইসরায়েলি সৈন্যদের ভূমিকা পালন করত, তারা রাইফেলের মতো লম্বা কাঠের টুকরো, অথবা যদি থাকত তাহলে খেলনা বন্দুক বহন করত।

খেলাটা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার সাথে সাথেই দুই পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে যেত। টিভির পর্দায় সংবাদে এবং পরবর্তীতে প্রতি শুক্রবার আমাদের গ্রামের প্রতিরোধ মিছিলের সময় আমরা যেরকম সংঘর্ষ দেখতাম, ঠিক সেভাবে।

খেলায় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দিকে ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ত, আর সেনাবাহিনী পাল্টা তাদের খেলনা বন্দুক দিয়ে “গুলি” করত। সৈন্যরা ফিলিস্তিনিদের তাড়া করত, যতক্ষণ না তারা মাটিতে পড়ে যেত।

ফিলিস্তিনিরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করত, কিন্তু সৈন্যরা তাদেরকে হাতের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এরপর গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত। এক্ষেত্রে পুরনো জুতার ফিতাগুলোকে আমরা হাতকড়া হিসেবে ব্যবহার করতাম।

আমি সাধারণত অন্য মেয়েদের সাথে ডাক্তারের ভূমিকা পালন করতাম। যখন আমি ফিলিস্তিনিদের চিৎকার শুনতে পেতাম যে তাদেরকে গুলি করা হয়েছে, তখন আমি তাদের চিকিৎসার জন্য ছুটে যেতাম। কিন্তু যখন আহতদের সেবা করার কাজ থাকত না, তখন আমি নিজেও পাথর ছুড়ে প্রতিরোধে অংশ নিতাম।

সাংবাদিক হিসেবে অভিনয় করা কিছু বাচ্চা থাকত, তারা সবকিছু নথিভুক্ত করার ভান করত। মাঝে মাঝে তারা ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের সাক্ষাৎকারও নিত। এই সাক্ষাৎকার পর্বগুলো বেশ মজার হতো।

খেলার নিয়ম ছিল, কোনো ফিলিস্তিনি যদি ইসরায়েলিদের হাতে গ্রেপ্তার হতো, তাহলে সে খেলার অযোগ্য হয়ে যেত। কিন্তু কেউ নিহত হয়ে শহিদ হলে সে আবার জীবিত হয়ে অন্য কোনো ভূমিকায় ফিরে আসতে পারত।

মাঝে মাঝে অবশ্য আমরা নিয়ম ভঙ্গ করতাম। গ্রেপ্তার হওয়া বাচ্চাদের মধ্যে কাউকে কয়েক বছরের কারাদণ্ড ভোগ শেষেই আমরা গান গেয়ে, উৎসব করে, ফুলার মালা দিয়ে মুক্ত করে আনতাম।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় সারাদিনই আমরা জাইশ ওয়া আরাব খেলতাম। আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদেরকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। আমরা এত আবেগ দিয়ে খেলাটা খেলতাম যে আমাদের মনে হতো আমরা বুঝি সত্যি সত্যিই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করছি।

আমরা হয়তো আরও কিছুদিন জাইশ ওয়া আরাব খেলা চালিয়ে যেতাম। কিন্তু আমার বয়স যখন ছয় বছর, তখন আমাদের গ্রামে হঠাৎ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের কারণে আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে আমরা সৈন্যদেরকে শুধু দূর থেকেই দেখতে পেতাম। কিন্তু তখন থেকে তারা আমাদের গ্রামের একটা অংশ দখল করে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে।

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর প্রথম অধ্যায়, “Childhood” থেকে।

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

আমার নতুন বই!!!

স্পাই স্টোরিজ ২: স্নায়ুযুদ্ধের সফলতম ডাবল এজেন্টের কাহিনি

অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে ননফিকশন স্পাই থ্রিলার। উচ্চপদস্থ এক ডাবল এজেন্টের কাছে ১৫ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনি।

৪০০ .০০

বইমেলায় থাকছে ৪৩৯ নম্বর (সতীর্থ প্রকাশনার) স্টলে। এছাড়াও পাবেন রকমারি ডট কমে (৩৫% ছাড়ে), প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ (৩৫% ছাড়ে) এবং আপনার পছন্দের যেকোনো অনলাইন বুকশপে।

বিস্তারিত
Short PDF

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে আহেদ তামিমির সাক্ষাৎ

আমার বয়স যখন ১১ বছর, তখন একদিন আমি খবর পাই, ইসরায়েলি সৈন্যরা আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথেই আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, তাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ভাইকে উদ্ধার করার চেষ্টা করি।

সৈন্যদের সাথে আমার এই সংঘর্ষের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়। সোনালি চুলের পিচ্চি একটা মেয়ে তাদের চেয়ে দুই ফিট লম্বা সশস্ত্র ইসরায়েলি সৈন্যদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত মুঠ করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে – এই দৃশ্য মানুষকে অভিভূত করে। অনেকে মন্তব্য করে, আমি নাকি ফিলিস্তিনি শিশুদের সাহসিকতা এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক।

কিন্তু সত্যি কথা বলতে, মানুষ কী ভাবছে, সেটা নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা আমার ছিল না। আমি শুধু চাইছিলাম আমার ভাইকে মুক্ত করতে।

ঐ ঘটনার পর আমাকে এবং আমার মাকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে আমাকে “হান্দালা” নামক সাহসিকতার পুরস্কার দেওয়া হয়। ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি পোশাক আর গলায় কুফিয়াহ পরে আমি পুরস্কার গ্রহণ করি।

আমি যখন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াই, তখন অনুষ্ঠানের প্রধান আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি সৈন্যদের সামনে কোন হাতের মুষ্টি তুলে কথা বলেছিলাম? ডান নাকি বাম?
আমি যখন উত্তর দিলাম “ডান”, তখন তিনি আমার ডান হাতটা তার হাতে নিয়ে তাতে চুমু দেন।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পুরস্কার পেয়ে আমার কেমন লাগছে? আমি বলেছিলাম, আমার গর্ববোধ হচ্ছে। আমি আসলেই পুরস্কার পেয়ে গর্বিত ছিলাম, কিন্তু মাত্র এগারো বছর বয়সে আমি সেই মুহূর্তের বিশালতা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।

ঐ দুই সপ্তায় আমাকে ক্যামেরার সামনে যে পরিমাণ সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছিল, সেটা আমার স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। ইন্টারভিউর চেয়ে আমি বরং আমার নবী সালেহ গ্রামে ফিরে গিয়ে আমার বন্ধুদের সাথে “জাইশ ওয়া আরাব” খেলতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম।

আমার ভিডিওটা তুরস্কে কী পরিমাণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেটা আমি বুঝেছিলাম যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান এক সকালে আমাদেরকে সানলিউরফা প্রদেশে তার হোটেলে ফ্লাই করিয়ে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমাকে এবং আমার মাকে নাস্তার জন্য আমন্ত্রণ জানন এবং বেশ কিছু উপহার দেন।

এরদোয়ান আমাকে বলছিলেন যে তিনি ফিলিস্তিনকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন, এবং তুরস্ক সবসময়ই ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করবে।

উত্তরে আমি পাল্টা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি যদি ফিলিস্তিনকে ভালোই বাসেন, তাহলে আমাদেরকে যেখানে আপনার দেশে ভিসা নিয়ে প্রবেশ করতে হয়, সেখানে ইসরায়েলিরা কেন ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারে?”

এরদোয়ান কোনো উত্তর দেননি। তার উত্তর দেওয়ার কী-ই বা ছিল?

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর পঞ্চম অধ্যায়, “The Spotlight” থেকে।

মাহমুদ আব্বাস: দখলদারিত্বের সাব-কন্ট্রাক্টর

জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি একবার দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন সব সময়ই আমার পছন্দের একজন নেতা। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বিপ্লবী এবং প্রচণ্ড নীতিবান নেতা, যিনি সারা বিশ্বের সামনে তার সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

দুঃখের বিষয়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সম্পর্কে  এই বিশেষণগুলো আমি কখনোই ব্যবহার করতে পারিনি। প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্বাসের গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট যে ২০০৯ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটা বাদ দিলেও আমি কখনোই তার নেতৃত্বের ভক্ত ছিলাম না। 

আব্বাস তার পুরো জীবন কাটিয়েছেন ইসরায়েলের সাথে নিষ্ফল আলোচনার পেছনে সময় নষ্ট করে, যা অধিকাংশ ফিলিস্তিনি জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়নের পরিবর্তে তিনি বরং তার নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন দখলদারিত্বের সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে। এবং এর মাধ্যমে তিনি ইসরায়েলকেই সহায়তা করেছেন। 

তার নিরাপত্তাবাহিনী ইসরায়েলের সাথে সমন্বয় করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যাতে তাদের দখলদারিত্ব যথাসম্ভব দক্ষতার সাথে, ঝামেলাবিহীনভাবে চলতে পারে। অনেক ফিলিস্তিনির যেখানে বেঁচে থাকার মতো অর্থ জোগাড় করতেই কষ্ট হয়, সেখানে আব্বাসের শাসনামলে প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির কর্মকর্তারা আরও ধনী হয়েছে। তাদের সন্তানদেরকে প্রায়ই চটকদার মার্সিডিজ আর বিএমডব্লিউ গাড়িতে করে রামাল্লার চারপাশে জয় রাইড দিতে দেখা যায়। 

কিন্তু এগুলো সব বাদ দিলেও আমার চোখে আব্বাস তার সব বৈধতা হারিয়েছেন ২০১২ সালে, যখন তিনি একটা ইসরায়েলি নিউজ চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ঐ সাক্ষাৎকারে তাকে যখন  জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তিনি ১৯৪৮ সালে দখল হয়ে যাওয়া তার জন্মস্থান সাফেদ নামক গ্রামে বসবাস করতে চান কি না, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার গ্রামটা দেখার অধিকার আছে, কিন্তু সেখানে বসবাস করার অধিকার নাই … আমার জন্য ফিলিস্তিন এখন শুধুমাত্র ১৯৬৭ সালের সীমানার অংশটুকু, যার রাজধানী পূর্ব জেরুজালেম।” 

এই উত্তরের মধ্য দিয়ে আব্বাস প্রতিটা ফিলিস্তিনি নাগরিক, বিশেষ করে প্রতিটা শরণার্থীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমার কাছে এই অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য।

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর পঞ্চম অধ্যায়, “The Spotlight” থেকে।

এই আর্টিকেলটা যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমার এই বইটাও আপনার ভালো লাগতে পারে:

গল্পগুলো সিরিয়ার: বুলেট, রক্ত, রাজনীতি এবং বিপন্ন মানবতা

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হচ্ছে এই সময়ের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রধান শিকার, সিরিয়ার সাধারণ জনগণ সম্পর্কে তেমন কিছুই আমরা জানি না।

আমরা জানি না কীভাবে তারা অবরোধ, দুর্ভিক্ষ আর বিমান হামলার মধ্য দিয়ে একটা একটা করে দিন অতিবাহিত করেছে, কীভাবে অপহৃত আত্মীয়-স্বজনদের বেঁচে ফেরার আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনেছে, কীভাবে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেছে, কীভাবে নতুন জীবনের আশায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।

“গল্পগুলো সিরিয়ার” বইটি সেই হৃদয় বিদারক অজানা কাহিনীগুলোই তুলে এনেছে পাঠকদের সামনে।

বিস্তারিত
Short PDF

ফিলিস্তিন এবং ফুটবল: আহেদ তামিমির দুই আবেগের মিলন

ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। ফুটবল শুধু আমার শখ ছিল না; সে সময় আমার প্রধান স্বপ্নই ছিল বড় হয়ে বার্সেলোনার প্রফেশনাল ফুটবলার হওয়া। 

ভালো ফুটবলার হতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। স্কুলের অফ পিরিয়ডে এবং লাঞ্চ ব্রেকে আমি নিয়মিত ফুটবল প্র্যাকটিস করতাম। আমি স্পোর্টস সম্পর্কে প্রতিটা খুঁটিনাটি ফ্যাক্ট মুখস্থ করতাম। এমন কোনো খেলোয়াড় ছিল না যাকে আমি চিনতাম না, এবং এমন কোনো ম্যাচ ছিল না যেটা আমি দেখতাম না। এমনকি যদি এর জন্য সারা রাত জেগে থাকতে হতো, তবুও। 

কিছু সময়ের জন্য মেসি ছিল আমার আইডল। কিন্তু আমার ১২ বছর বয়সের সময় নেইমার যখন বার্সেলোনায় যোগ দেয়, তখন আমার সব সমীকরণ পাল্টে যায়। নেইমারের সবকিছু আমার ভালো লাগত- তার খেলার দক্ষতা, তার আকর্ষণীয় চেহারা এবং তার মন কাড়া হাসি – নেইমার হয়ে ওঠে আমার প্রথম অফিশিয়াল ক্রাশ। 

ক্রাশ শব্দটা সম্ভবত আন্ডারস্টেটমেন্ট; আমি নেইমারে পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কম্পিউটার নেইমারের ছবিতে ভরে গিয়েছিল। আমার বিছানার উপরে মেসির পাশে নেইমারের ছবিও স্থান পেয়েছিল। 

সময়ের সাথে সাথে আমি আমার চাচাতো বোন জান্নাকেও একজন ডাই-হার্ড নেইমার ফ্যানে রূপান্তরিত করে ফেলি। একবার নেইমারের জন্মদিনে আমরা তার সম্মানে একটা কেক বানিয়েছিলাম এবং সেটার উপর অগোছালোভাবে গোলাপী ফ্রস্টিং দিয়ে তার নাম লিখে দিয়েছিলাম। 

আমার স্বপ্ন ছিল নেইমারের সাথে দেখা করা এবং তার মতো একজন ভালো খেলোয়াড় হয়ে ওঠা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দখলদারিত্বের অধীনে বেড়ে ওঠার নির্মম বাস্তবতা আমাকে এই দুটো স্বপ্নই ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল।

এর কয়েক বছর পর, ইসরায়েলি সৈন্যকে চড় দিয়ে ভাইরাল হয়ে জেল খেটে বের হওয়ার পর, আমার ঠিকই একবার স্পেনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এবং সে সময় বার্সেলোনা না, বরং রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা একটা প্রাপ্তি।

আট মাস জেল খেটে বের হওয়ার পর আমাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নিজের অভিজ্ঞতা এবং ফিলিস্তিনিদের করুণ অবস্থা তুলে ধরার জন্য। সে সময় আমি যখন স্পেনে ছিলাম, তখন রিয়াল মাদ্রিদ আমাকে আমন্ত্রণ জানায়।

সান্তিয়াগো বার্নাবেউ স্টেডিয়ামে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে একটা ম্যাচের ঠিক আগে রিয়াল মাদ্রিদের কো-ম্যানেজার এবং প্রাক্তন ফরোয়ার্ড এমিলিও বুট্রাগুয়েও আমাকে স্বাগত জানান। তিনি যখন আমার নাম লেখা রিয়াল মাদ্রিদের একটা জার্সি আমাকে উপহার দিচ্ছিলেন, তখন আমি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছিলাম না। 

যদিও আমি সারাজীবনই বার্সেলোনার ফ্যান, কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ টিমের সাথে দেখা করা এবং প্রথমবারের মতো একটা সত্যিকারের ফুটবল স্টেডিয়াম দেখা ছিল আমার ছোটবেলার স্বপ্নের কিছুটা অংশের বাস্তবায়ন। এবং যে দলটাকে আমি সারাজীবন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতাম, এই ঘটনার মাধ্যমে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। 

আমার ধারণা ছিল না যে ফিলিস্তিনি জনগণের বার্তা বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ফুটবল স্টেডিয়াম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমার সেই সফরের মধ্য দিয়ে আমার দুটি আবেগ –  ফিলিস্তিন এবং ফুটবল, একটা সুন্দর, অপ্রত্যাশিত উপায়ে একসাথে মিশে গিয়েছিল। 

ইসরায়েলের অবশ্য এই ঘটনাটা সহ্য হয়নি। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমাকে সম্মানিত করার জন্য রিয়াল মাদ্রিদকে “শেমফুল” বলে অভিহিত করেছিলেন। তার সরকার পরিষ্কারভাবেই আরও একটা আন্তর্জাতিক প্রত্যাখ্যান হজম করতে পারেনি।

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর প্রথম অধ্যায় “Childhood” এবং অষ্টম অধ্যায় “Homecoming” থেকে।

যে কারণে ফিলিস্তিনিরা শার্ট ইন করে মিছিল করে

আমরা ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই একটা অব্যক্ত নিয়ম তৈরি করে নিয়েছিলাম যে ফিলিস্তিনি তরুণরা মিছিলে অংশগ্রহণ করার সময় লম্বা শার্ট পরবে না, অথবা পরলেও তাদেরকে শার্ট ইন করে রাখতে হবে। 

এটা করা হতো নিজেদেরকে গোপন ইসরায়েলি এজেন্ট তথা ‘মুস্তারেবিন’দের থেকে আলাদা করার জন্য, যারা সাদা পোশাকে ফিলিস্তিনিদের ছদ্মবেশে আমাদের মিছিলগুলোতে অংশগ্রহণ করে, এবং এরপর মিছিলকারীদের উপর হামলা ও গ্রেপ্তার করে। 

তারা আমাদের সাথে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার জন্য কুফিয়াহও পরিধান করে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাদেরকে কোমরের বেল্টের নিচে পিস্তল লুকিয়ে রাখার জন্য শার্টগুলোকে বেল্টের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। 

সেজন্য যখনই আমরা পুরুষদেরকে শার্ট ইন না করে মিছিলে আমাদের পাশে হাঁটতে দেখে, তখনই আমরা অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যাই— আমরা জানি, তারা সম্ভবত গোপন এজেন্ট।

আর সেজন্যই ফিলিস্তিনিরা তরুণরা মিছিলে যোগ দেওয়ার সময় শার্ট ইন করে রাখে। তারা আমাদেরকে আশ্বস্ত করে – দেখ, আমাদের সাথে পিস্তল নেই। আমরা তোমাদের দলেরই মানুষ।

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর ষষ্ঠ অধ্যায় “The Slap” থেকে।

ইমেইলের মাধ্যমে নতুন পোস্টের আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করে 30 জনের সাথে যোগ দিন।

জেলখানার নির্যাতনের মুখেও আহেদ তামিমি যেভাবে শক্ত ছিল

আমাকে আটক করার পর কয়েক ঘণ্টা ধরে সৈন্যরা শুধু একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল- “তোমার পেছনে আর কে আছে?”। কিন্তু আমার ইহুদী আইনজীবির পরামর্শ অনুযায়ী আমি শুধু বারবার একটা উত্তরই দিয়ে যাচ্ছিলাম- “আই রিটেইন মাই রাইট টু রিমেইন সাইলেন্ট!”

তারা বিভিন্নভাবে আমাকে রাগিয়ে, ক্ষেপিয়ে কথা বলাতে চাচ্ছিল। কিন্তু ছোটকাল থেকে শত শত বার আমার বাবা, চাচা, ভাই এবং কাজিনদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল। আমি জানতাম কীভাবে এরকম জিজ্ঞাসাবাদে টিকে থাকতে হয়।

আমার বিশেষভাবে বাবার ইন্টারোগেশনের কথা মনে পড়ছিল। আমার জন্মের আগে, ১৯৯৩ সালে, এক ইন্টারোগেশনের সময় টর্চারে তাকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যেতে হয়েছিল। সেবারের ইন্টারোগেশন এতটাই নির্মম ছিল, এবং বাবার আঘাতগুলো এতটাই গুরুতর ছিল যে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাবার কেসটা নথিভুক্ত করেছিল। 

ইন্টারোগেশন রুমে বাবার মাথায় এত বেশি আঘাত করা হয়েছিল যে তিনি সেরিব্রাল হেমোরেজের শিকার হয়েছিলেন এবং দশ দিন পর্যন্ত কোমায় পড়ে ছিলেন। জ্ঞান ফেরার পরেও তিনি সাময়িকভাবে প্যারালাইজড ছিলেন। তার মাথায় ছত্রিশটা সেলাই দিতে হয়েছিল। এত কিছুর পরেও তারা তার মুখ থেকে এমন কিছু বের করতে পারেনি, যার দ্বারা তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা যায়।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইসরায়েলিরা প্রায়ই ফিলিস্তিনি বন্দীদের উপর শারিরীক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করে, যেন তাদের মনোবল নষ্ট করে তাদের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়। কিন্তু এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয় না। অনেক সময়ই তারা যদি দেখে কোনো বন্দী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে আসছে এবং মুখ খুলতে যাচ্ছে, তখন তারা তাদেরকে নিজেদের স্পাইয়ে রূপান্তরিত করার আশায় আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। আমি কখনোই নিজেকে সেরকম হতে দিতে দিবো না!

জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বাঁচার জন্য আমি নিজের শরীর থেকে মনকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করছিলাম। শারীরিকভাবে আমি ইন্টারোগেটরদের সামনে বসে ছিলাম, কিন্তু মানসিকভাবে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম নিজের তৈরি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে। তাদের প্রশ্নের দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমি মনে মনে একের পর এক ফিলিস্তিনি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে যাচ্ছিলাম, সেগুলো শেষ করে কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছিলাম।

আরও কয়েকঘণ্টা এভাবে কাটার পর অবশেষে ইন্টারোগেটররা সেদিনের মতো হাল ছেড়ে দিলো। আমার মুখ থেকে তারা একটা প্রশ্নের উত্তরও বের করতে পারেনি।

আহেদ তামিমির আত্মজীবনী “They Called Me a Lioness”-এর ষষ্ঠ অধ্যায় “The Slap” থেকে।

আমার অনুবাদ যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে সবগুলো অনুবাদ পড়তে পারেন এই পাতা থেকে:

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *