আমার লেখা যারা কয়েক বছর ধরে পড়েন, তাদের জানার কথা, হাসিনা রেজিমকে আমি বিভিন্ন সময় সিরিয়ার আসাদ রেজিমের সাথে তুলনা করেছি।
হাসিনা রেজিমের সাথে আসাদ রেজিমের পার্থক্য একটাই: হাসিনা এবং তার পরিবার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতোই সুন্নি; কিন্তু আসাদ রাজবংশ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো সুন্নি না। তারা সংখ্যালঘু আলাউই।
কিন্তু এর বাইরে এই সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি, ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিপরীত ধর্মের রেজিওনাল সুপার পাওয়ারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা – এরকম অনেক কিছুতেই হাসিনা রেজিমের সাথে আসাদ রেজিমের বেশ ভালোরকম মিল আছে।
আসাদ রেজিমের প্রধান ঘুঁটি ছিল সংখ্যালঘু আলাউইরা। আলাউইদের সংখ্যা সেখানে মোটামুটি ১০-১২%। অথচ সিরিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে, ইভেন সেনাবাহিনীর প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে আলাউইদের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।
কম্পেয়ার দ্যাট উইথ হাসিনা রেজিম – পুলিশ ক্রুশিয়াল পোস্টগুলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় হাসিনা আনুপাতিক হারের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে হিন্দুদেরকে নিয়োগ করেছিল।
সিরিয়াতে সংখ্যালঘু আলাউইদেরকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ফলাফল কী ছিল? যখন বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন এই আলাউইরা বুঝতে পারে, তাদের আর যাওয়ার কোনো উপায় নাই।
অন্য কেউ, বিশেষ করে সুন্নি কেউ ক্ষমতায় আসলে কোনো রকম ডিসক্রিমিনেশন ছাড়াই, স্বাভাবিক যোগ্যতা এবং অনুপাতের ভিত্তিতেই তারা ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এতদিন পর্যন্ত যেসব অন্যায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে, যেসব অবৈধ সম্পত্তি উপার্জন করেছে, সবকিছুর তদন্ত হবে, বাজেয়াপ্ত হবে, বাতিল হবে। ফলে এই আলাউইরা দলবেঁধে আসাদ রেজিমের পক্ষে অবস্থান নেয়।
শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদেরকে ক্ষমতায়ন করে, বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খুব বেশি লাভ আদায় করা যায় না। এরজন্য প্রয়োজন হয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। সময়ে সময়ে তাদের উপর আক্রমণ করা। সংখ্যাগুরুর ধর্মকে মৌলবাদী ধর্ম হিসেবে প্রচার করা। জঙ্গিবাদ যতটা না বাস্তব, সেটাকে ১০০ গুণ বাড়িয়ে, নাটক সাজিয়ে, সংখ্যালঘুদের মানসিকতা এমনভাবে শেপ করা, যেন তাদের একটা অংশ জানপ্রাণ দিয়ে রেজিমের জন্য শেষ লড়াইটুকু লড়ে যায়।
এই আর্টিকেলটা যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমার এই বইটাও আপনার ভালো লাগতে পারে:
গল্পগুলো সিরিয়ার: বুলেট, রক্ত, রাজনীতি এবং বিপন্ন মানবতা
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হচ্ছে এই সময়ের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রধান শিকার, সিরিয়ার সাধারণ জনগণ সম্পর্কে তেমন কিছুই আমরা জানি না।
আমরা জানি না কীভাবে তারা অবরোধ, দুর্ভিক্ষ আর বিমান হামলার মধ্য দিয়ে একটা একটা করে দিন অতিবাহিত করেছে, কীভাবে অপহৃত আত্মীয়-স্বজনদের বেঁচে ফেরার আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনেছে, কীভাবে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেছে, কীভাবে নতুন জীবনের আশায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।
“গল্পগুলো সিরিয়ার” বইটি সেই হৃদয় বিদারক অজানা কাহিনীগুলোই তুলে এনেছে পাঠকদের সামনে।
এর প্রতিফলন আমরা বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াতেও অহরহ দেখতে পাই। বাংলাদেশে কত পার্সেন্ট হিন্দু? ১০ পার্সেন্ট? অথচ প্রথম আলো থেকে শুরু করে রোর বাংলা পর্যন্ত যতগুলো বাংলাদেশী মিডিয়ার ফেসবুক কমেন্ট সেকশন দেখেছি গত পাঁচ-সাত বছরে, সেখানে হাসিনা রেজিমকে আনুপাতিক হারের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সংখ্যায়, অনেক উগ্রভাবে ডিফেন্ড করেছে হিন্দু আইডিগুলো।
যদি ১০০টা কমেন্ট থাকে হাসিনার পক্ষে, তারমধ্যে ৩০-৪০% ই হিন্দু আইডির। কেউ যদি প্রো-ইসলামিক কোনো লেখা লেখে, তাকে সরাসরি জঙ্গি ট্যাগ দেওয়ার কাজটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হিন্দু আইডিগুলো থেকেই করা হতো। জাস্ট মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন টপিক নিয়ে লেখার কারণে এ পর্যন্ত যতবার জঙ্গি ট্যাগ খেয়েছি, বেশিরভাগই খেয়েছি হিন্দু আইডিগুলো থেকে।
কারণটা ওটাই। উপরে যা বলেছি। একদিকে তাদেরকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো, বিপরীতে তাদের উপর ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাক করা এবং সেই সাথে কন্টিনিউয়াসলি মিডিয়াতে জামাত-শিবির-জঙ্গিবাদ নিয়ে এমন প্রপাগান্ডা প্রচার করা, যেন তাদের মনে হয়, হাসিনা রেজিম না থাকলে হিন্দুরা সব নাই হয়ে যাবে।
অথচ বাস্তবে কী হয়েছে? হাসিনা রেজিমের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে, সেক্যুলার মিডিয়া ডেইলি স্টার এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বয়ান অনুযায়ীই, এই আক্রমণগুলোর প্রায় সবই রাজনৈতিক আক্রমণ।
ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই “হিন্দু” হওয়ার কারণে আক্রমণ হয়নি, হয়েছে “আওয়ামী লীগ” হওয়ার কারণে। এবং এই আওয়ামী লীগারদের মধ্যে মুসলমান আওয়ামী লীগের উপরেও প্রচুর আক্রমণ হয়েছে।
আক্রমণগুলোতে কয়জন হিন্দু মারা গেছে? আল-জাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী দুইজন। ধরে নিলাম নিউজে না আসা সব ধরলে দশ জনই হবে। বিপরীতে মুসলমান আওয়ামী লীগ কয়জন মারা গেছে? আনুপাতিক হারেই আরও অনেক অনেক বেশি।
আর অনেকগুলো রিপোর্টেই এখন উঠে আসছে, অনেক জায়গায় পাবলিকের হাতে, সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে, (আওয়ামী) হিন্দুরা এবং আওয়ামী লীগ নেতারাই অনেকগুলো হিন্দু বাড়িতে এবং মন্দিরে আক্রমণ করিয়েছে।
আমার সবগুলো বই
দুনিয়ার যেকোনো দেশে অভ্যুত্থানের পর আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে যেখানে পুলিশ বা সেনাবাহিনীকে সরাসরি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরকে দলীয় খুনী বাহিনীতে রূপান্তিরত করা হয়, সেখানে সরকার পতনের পর যখন এই পুলিশ বা সেনাসদস্যরা পালিয়ে যায়, তখন আইন-শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে।
এরকম পরিস্থিতি প্রচুর অপরাধ হয়, কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত-বিক্ষুব্ধ জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, প্রচুর প্রতিশোধমূলক হত্যাকান্ড ঘটায়, লুটপাট করে। এগুলো জাস্টিফাইয়েবল না; কিন্তু এগুলোই ঘটে। দুনিয়ার সবদেশেই ঘটে।
বাংলাদেশে গত দেড় দশকে জনগণের উপর যে পরিমাণ অবর্ণনীয় নির্যাতন চলেছে, যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করা হয়েছে, এরমধ্যে কিছু মানুষ যেভাবে ব্যাপারগুলো রাজনৈতিক হিসেবে না দেখে ধর্মীয়ভাবে দেখেছে এবং প্রচার করেছে, এবং তার উপর বাংলাদেশ যেরকম দরিদ্র এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাতে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
কিন্তু সেটা ঘটেনি। কিছু মানুষ হামলা করলেও, আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ যেরকম রেস্ট্রেইন্ট দেখিয়েছে, যেভাবে দলে দলে সাধারণ মানুষ, মাদ্রাসার ছাত্ররা, ইভেন শিবিরের ছেলেরা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দেওয়ার জন্য নেমে পড়েছে, সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য।
আমার বিশ্লেষণমূলক লেখা যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে আমার এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন:
সিরিয়াতে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর আলাউদেরকে নিজের পক্ষে মোবিলাইজ করার জন্য বাশারের গোয়েন্দাবাহিনী সুন্নিপ্রধান এলাকায় নিজের পক্ষের সুন্নি শাবিহাদেরকে দিয়ে আলাউদের উপর আক্রমণ করিয়েছে, আর আলাউই প্রধান এলাকায় আলাউই শাবিহাদেরকে দিয়ে সুন্নিদের উপর আক্রমণ করিয়েছে।
ফলে বেশিদিন লাগেনি; যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল নিছক রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে, সেটা দ্রুতই প্রথমে সরকার পতনের আন্দোলন থেকে শুরু করে এরপর সাম্প্রদায়িক যুদ্ধে রূপ নেয়। আর এর ফলাফল পুরোপুরি যায় বাশার আল-আসাদের পক্ষে।
বাংলাদেশেও হাসিনার অনুগত বাহিনী এখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে হিন্দুদের উপর আক্রমণ করার। হিন্দুদেরকে দিয়ে কান্নাকাটির অভিনয় রেকর্ড করে প্রচার করার। তাদেরকে মোবিলাইজ করার। এখন পর্যন্ত তাদের এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর আগে প্রতিবার মানুষ তাদের ফাঁদে পা দিলেও এবার তাদের এই সাম্প্রদায়িক কার্ড মানুষ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।
তবে তারা এখনও থামেনি, সহজে থামবেও না। এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রথম পর্ব সফল না হলে পরবর্তীতে হয়তো তারা “বিক্ষুব্ধ” কোনো হিন্দুকে দিয়ে মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থানেও আক্রমণ করার নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে। আশা করি, তখনও মানুষ তাদের সেই খেলা ধরে ফেলতে পারবে এবং সাবধানতার সাথে রেসপন্স করবে।
হাসিনা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। মানুষের উপর গুলি চালিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছিল। সেরকম হলে দেশে লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারত। একটুর জন্য আমরা সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছি। এখন সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে যেন দেশকে সিরিয়ার দিকে নিয়ে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।