মেহদি হাসান-এর Win Every Argument বইয়ের টুকরো অনুবাদ

মেহদি হাসান হচ্ছেন আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা বিতার্কিক এবং টিভি ইন্টারভিউয়ার। আল-জাজিরার হেড টু হেড অনুষ্ঠানে তিনি বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতাদেরকে যেভাবে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতেন, সেটার তুলনা পাওয়া কঠিন।

সেই মেহদি হাসান গত বছর একটা বই লিখেছেন। নাম উইন এভ্রি আর্গুমেন্ট (Win Every Argument: The Art of Debating, Persuading, and Public Speaking)। বইটাতে তিনি বিতর্কে জেতার বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

চমৎকার এই বইটা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আমি ফেসবুকে এর টুকরো কিছু অংশের ভাবানুবাদ করেছিলাম। সেগুলোই তুলে দিচ্ছি এখানে।

১। ডেল কার্নেগির সাথে মেহদি হাসান-এর দ্বিমত

ডেল কার্নেগি তার ১৯৩৬ সালের ক্লাসিক বই How to win Friends & Influence People-এ লিখেছিলেন:

এই দুনিয়ায় তর্কে জেতার একমাত্র শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে তর্কে না জড়ানো। তর্ককে সেভাবে এড়িয়ে চলুন, যেভাবে মানুষ সাপ এবং ভূমিকম্পকে এড়িয়ে চলে।

কিন্তু কার্নেগির এই অনুসিদ্ধান্তে আমার আপত্তি আছে। কার্নেগি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো আমরা এই বিষয়ে একটা বিতর্ক করতে পারতাম।

— মেহদি হাসানের Win Every Argument বইয়ের Introduction: The Art of the Argument অধ্যায় থেকে।

২। বিতর্কে জেতার জন্য স্টোরিটেলিংয়ের গুরুত্ব

স্টোরিটেলিং হচ্ছে মানুষকে প্ররোচিত করার একটা সুপ্ত উপায়।

২০০৭ সালে হোয়ার্টন ইউনিভার্সিটির মার্কেটিং অ্যান্ড সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ডেবোরা স্মল তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, মানুষ একই ধরনের দুর্দশায় পতিত অনেক বেশি সংখ্যক “স্ট্যাটিস্টিক্যাল ভিক্টিম”দের কাহিনী শুনে যে পরিমাণ অর্থ দান করে, তার চেয়ে অনেক বেশি দান করে একজন সিঙ্গেল “আইডেন্টিফাইয়েবল ভিক্টিম”-এর গল্প শুনে।

সাহায্যপ্রার্থী লক্ষ লক্ষ নাম-না-জানা, চেহারা-না-চেনা মানুষের চেয়ে ছবি এবং নামসহ একটামাত্র শিশুর গল্প আমাদের অনুভূতিকে অনেক বেশি এবং অনেক সরাসরি নাড়া দেয়।

— মেহদি হাসানের Win Every Argument বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় Feeling, No (Just) Facts থেকে।

৩। বিতর্কে জেতার জন্য মনযোগ দিয়ে শোনার গুরুত্ব

বিতর্কে জেতা শুধুমাত্র ভালো বলতে পারার উপর নির্ভর করে না; ভালো শুনতে পারার উপরেও নির্ভর করে। বলা হয়ে থাকে, বিতর্কে যেহেতু মানুষ কেবল অর্ধেক সময় কথা বলার সুযোগ পায়, তাই ভালো করে শুনতে পারলেই বিতর্কে অর্ধেক জিতে যাওয়া যায়।

যদিও সত্য কথা বলতে, আমি যখন আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম যে মনোযোগ দিয়ে শোনার গুরুত্বের উপর আমি একটা অধ্যায় লিখছি, সে হো হো করে হেসে উঠেছিল। এরপর হাসি থামিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “সিরিয়াসলি? তুমি লিখছ ভালো শ্রোতা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে?”

তার বক্তব্যে যুক্তি ছিল। আমি কখনোই খুব ভালো শ্রোতা ছিলাম না।

— মেহদি হাসানের Win Every Argument বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় Listen, Don’t (Just) Speak থেকে।

৪। বিতর্কে ক্রিটিক্যাল লিসেনিং এবং নোট টেকিংয়ের গুরুত্ব

২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিয়নে “ইসলাম এবং শান্তি” নিয়ে বিতর্কের সময় ইসলাম-বিরোধী পক্ষের কাছ থেকে একের পর এক মিথ্যা এবং প্রতারণামূলক যুক্তি শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

আমি কী বক্তব্য উপস্থাপন করব, সেই স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লিখে, প্রিন্ট করে হাতে ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার কথা বলার পালা আসার আগেই আমি পাশের ব্যক্তির কাছ থেকে একটা কলম চেয়ে নিয়ে তাদের প্রতিটা হাস্যকর দাবি কাগজের উল্টোপিঠে লিখতে শুরু করলাম।

উদাহরণস্বরূপ, বিরোধীদলের প্রথম বক্তা, অ্যান মেরি ওয়াটার্স তার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে সৌদি আরব হচ্ছে ইসলামের জন্মস্থান, এবং সেজন্য সৌদিদের ইসলামের কঠোর এবং নির্মম সংস্করণই হচ্ছে ইসলামের সত্যিকার উদাহরণ।

তার গলাবাজি আর প্রলাপ শুনতে শুনতে আমি আমার সামনের কাগজে দুইটা সংখ্যা লিখে রাখলাম: ৬১০ এবং ১৯৩২। এরপর যখন আমার কথা বলার পালা এলো, তখন আমি আমার পূর্ব-প্রস্তুতকৃত বক্তৃতা পুরোপুরি উপেক্ষা করে সামনের কাগজের খসড়ার দিকে তাকিয়ে বললাম:

শুধু একটা তথ্যমূলক পয়েন্ট… আপনি বলেছেন ইসলামের জন্ম সৌদি আরবে। ইসলামের জন্ম হচ্ছে ৬১০ সালে। আর সৌদি আরবের জন্ম ১৯৩২ সালে। কাজেই আপনি মাত্র ১৩২২ বছর ভুল করেছেন! খারাপ না।

অক্সফোর্ড ইউনিয়ন চেম্বারের ভেতর জনতা যখন চিৎকার করে আমার বক্তব্যকে সমর্থন করছিল, ওয়াটার্স তখন চুপসে ছিল। ঐ লাইনটা আমি আগে থেকে প্রস্তুত করিনি, কিন্তু ওটাই ছিল ঐ বিতর্কের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা।

এটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র ক্রিটিকাল লিসেনিং আর নোট টেকিংয়ের কারণে।

— মেহদি হাসানের Win Every Argument বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় Listen, Don’t (Just) Speak থেকে।

৫। অনুশীলন: তোতলা থেকে নোবেলজয়ী বিতার্কিক হয়ে ওঠার উদাহরণ

আমাদের অনেকেরই ধারণা, যারা খুব ভালো বক্তা, তারা জন্মগতভাবেই ভালো বক্তা। কিন্তু এটা মোটেও সত্য না। উদাহরণ হিসেবে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের কথা বলা যায়।

ছোটবেলায় চার্চিলের তোতলামির সমস্যা ছিল। তিনি ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। কথা বলার সময় প্রায়ই তিনি আটকে যেতেন। এমনকি তিনি যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখনও তার এই সমস্যা ছিল। সে সময় এক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন-

চার্চিলের সাথে বাকপটুতার এখনও মৈত্রিতা স্থাপিত হয়নি। এবং আমার মনে হয় না ভবিষ্যতেও কখনও হবে।

১৯০৪ সালে চার্চিলের বয়স যখন ২৯ বছর, তখন একবার তিনি হাউজ অব কমন্সে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। তার শুরুটা ছিল চমৎকার। কোনো রকমের নোটের সাহায্য না নিয়ে, একেবারে স্মৃতি থেকে, পূর্ণ উদ্যমে, বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বক্তৃতার একেবারে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেই হঠাৎ তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন।

“And it rests with those who…” পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ মাঝপথেই তিনি থেমে যান। একটু থেমে তিনি আবারও চেষ্টা করেন, “It rests with those who…”। এরপর আবারও। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি পরের শব্দটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

পুরো তিন তিনটা মিনিট ধরে চার্চিল হাউজ অব কমন্সের সদস্যদের সামনে দাঁড়িয়ে সঠিক শব্দটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে যেতে থাকেন। পার্লামেন্ট সদস্যরা তার দিকে বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন ছুঁড়তে শুরু করে। তার অপমানিত চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। বক্তব্য মাঝপথে শেষ করেই বসে পড়তে হয় তাকে।

অথচ এই ঘটনার তিন যুগ পর এই চার্চিলই তার তুখোড় বক্তৃতার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ব্রিটিশ নাগরিককে নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এবং এরপর ১৯৫৩ সালে যখন তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, সেটা কিন্তু শান্তিতে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছিল সাহিত্যে! তার চমৎকার ঐতিহাসিক এবং জীবনীমূলক বর্ণনা এবং “অসাধারণ বাকপটুতা”র জন্য!

কীভাবে তিনি লাজুক, তোতলা, মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলা একজন সাধারণ বক্তা থেকে থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত, জাতিকে উদ্দীপ্তকারী, “ব্রিলিয়ান্ট” বাগ্মী হয়ে উঠেছিলেন? শুধুমাত্র অনুশীলন এবং প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে।

তার বহু জীবনীকারদের একজন, পরবর্তীকালের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লিখেছিলেন:

চার্চিলের বক্তৃতাগুলো ছিল তার প্রচেষ্টা এবং প্রস্তুতির ফসল। চার্চিল তার বাক্যাংশগুলোকে এমনভাবে রিভাইস দিতেন এবং ঠোঁটস্থ করতেন, যেভাবে মা-ভালুক তার শাবকদেরকে অনবরত চাটতে থাকে।

চার্চিল তার সম্পূর্ণ বক্তৃতা লিখে রাখতেন। তিনি এমনকি প্রতিটা পরিকল্পিত বিরতিও লিখে রাখতেন। কিন্তু বক্তৃতি দিতে উঠে তিনি সেগুলো রিডিং পড়তেন না। তার আরেক জীবনীকার উইলিয়াম ম্যানচেস্টার জানান, চার্চিল তার বক্তৃতার রিহার্সাল করার জন্য এত বেশি সময় ব্যয় করতেন যে সেগুলো তার প্রায় মুখস্থই হয়ে যেত। যখন তিনি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেন, তখন নোটগুলোর দিকে মাঝেমাঝে কয়েকবার তাকানোই তার জন্য যথেষ্ট হতো।

আর তার তোতলামি? সেই সমস্যাও চার্চিল সমাধান করেছিলেন প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে। যেমন S দিয়ে শুরু হওয়া শব্দগুলো উচ্চারণের সমস্যা কাটানোর জন্য তিনি বাইরে পায়চারি করার সময় জোরে জোরে S দিয়ে শুরু হওয়া হাস্যকর বাক্য পুনরাবৃত্তি করতেন। যেমন “The Spanish ships I cannot see since they are not in sight.” পরবর্তীতে তিনি গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিলেন: “আমার প্রতিবন্ধকতা আমার জন্য কোনো বাধা না।”

চার্চিল যেখানেই এবং যখনই পারতেন, তার বক্তৃতা অনুশীলন করতেন। তার কর্মী নরম্যান ম্যাকগোয়ান একটা গল্প বলেছিলেন যে একবার তিনি তার বসকে বাথটাবে শুয়ে বকবক করতে শুনেছিলেন। “আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?” উদ্বিগ্ন ম্যাকগোয়ান চার্চিলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

“আমি তোমার সাথে কথা বলছি না, নরম্যান,” চার্চিল উত্তর দিয়েছিলেন। “আমি হাউজ অফ কমন্সে ভাষণ দিচ্ছি।”

— মেহদি হাসানের Win Every Argument বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায় Practice Makes Perfect থেকে।

আমার অনুবাদ যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে সবগুলো অনুবাদ পড়তে পারেন এই পাতা থেকে:

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *